সোহেল সানি ॥ পৃথিবীর প্রথম মানব আদম (আঃ)। তাঁর দুই পুত্র কাবিল ও হাবিল। কাবিল তার ছোটভাই হাবিলকে হত্যা করে। হত্যার পর হাবিলের লাশ কাঁধে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল কাবিল। কেনো ভাই ভাইকে হত্যা করেছিলো, সেই লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনার আগে লাশ দাফনের প্রসঙ্গটি তুলে ধরছি। আজ বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত মানুষ লাশ বিভিন্নভাবে সমাধিস্থ করলেও প্রথম লাশটি কবরই দেয়া হয়েছিলো। লাশ কাঁধে বহনকালে অভিনব একটি বুদ্ধি কাবিলের মনে সঞ্চার হলো। জনশূন্য এলাকা হতে অগ্রসর হতে গিয়ে হঠাৎ কাবিলের চোখে পড়লো, দুটি কাক পরস্পরকে আক্রমণে লিপ্ত। একে অপরকে ঠোঁট দ্বারা মুহুর্মুহু আক্রমণ করছে। এক পর্যায়ে একটি কাক আরেকটি কাককে পর্যদুস্ত করে মেড়ে ফেললো।
কাবিল দেখলো, মৃত কাকটিকে পাশে রেখেই জীবিত কাকটি জমিন খুঁড়ে একটা গর্ত বানালো। মৃত কাকটিকে এবারে গর্তের মধ্যে ফেলে ঘাতক কাকটি মাটি চাপা দিয়ে উড়ে গেলো। যে কাবিল ছোট ভাইয়ের লাশ কি করবে সেই চিন্তায় অস্থির ছিলো, সেই কাবিলই কাকের এ দৃশ্য থেকে বিস্মিত হলো এবং নিজেই কাকের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবার জমিনের বুকে একটি গর্ত খুঁড়লো। সেই গর্তে হাবিলের লাশ রেখে মাটি দিয়ে ঢেকে দিলো।
প্রথম মানব হত্যার দায় এড়াতে পারলো না কাবিল। কবর দিয়ে এক কদম পা বাড়াতেই গায়েবী আওয়াজ ভেসে আসলো। আল্লাহ জমিনকে নির্দেশ করলো, “হে জমিন! কাবিলের বুক পর্যন্ত গ্রাস করো। সে ভাই হত্যার পাপে পাপী।” জমিন সঙ্গে সঙ্গে অভিশপ্ত কাবিলকে মাটি দ্বারা গ্রাস করলো। গায়েবি আওয়াজে কাবিল পাপের শাস্তি বুঝতে পেরে আল্লাহর কাছে কাকুতিমিনতি করে প্রার্থনা করতে লাগলো। কাবিল বললো, জন্মদাতার কাছে শুনেছি, ইবলিস গুনাহ করে তোমার আরশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলো, কিন্তু জমিন তাকে গ্রাস করেনি, আমার অপরাধ কি ইবলিশ অপেক্ষা বড়? আল্লাহর গায়েবি আওয়াজ ভেসে আসলো, “ইবলিশ যতবড় গুনাহ করুক না কেনো, সে মানব হত্যা করেননি।” তখন কাবিল বললো, হে মাবুদ! আমার পিতাও তো বেহেশতে থাকাকালীন তোমার হুকুম অমান্য করে গুনাহ করেছিলো, তাকে তুমি শাস্তি দিয়েছো বটে, কিন্তু তাকেও তো জমিন এভাবে দাবিয়ে রাখেনি। আল্লাহর জওয়াব এলো, হে নিষ্ঠুর বান্দা! তোমার পিতা আমার আদেশ অমান্য করে অন্যায় করেছিলো নিজের প্রতি, তুমি করেছে তোমার অন্যায় অপরাধ কেড়ে নিয়েছে অন্যের জীবন। কাবিল বললো, হে দয়াময় মাবুদ! আমি না বুঝে আমি মহা অপরাধ করেছি, এর অপেক্ষা আর বড় পাপ কিছুই হতে পারে না। কিন্তু তুমি তো মহাকৃপাময়, দয়ার আঁধার, ক্ষমাশীল। আমি পিতার মুখে শুনেছি, তুমি তাঁর গুনাহ ক্ষমা করেছিলে তোমার প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর নাম মুখে নিয়ে তাঁর উছিলায় ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। আমি সেই “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” পাঠ করছি। এবার মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বললেন, ‘হে জমিন কাবিলকে অবমুক্ত করে দাও। ‘এভাবে কাবিল জমিন হতে মুক্ত হয়ে হেঁটে বাসস্থানের অভিমুখে পৌঁছতে আল্লাহর আদেশে আজরাইল ফেরেশতা তার সম্মুখে হাজির হলো এবং কাবিলের জান কবজ করলো।
হাদিসগ্রন্থ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হুজুরে পাক মুহাম্মদ (সঃ) এরশাদ করেছেন যে, রোজ কেয়ামত পর্যন্ত যত হত্যা হতে থাকবে, প্রত্যেক হত্যাকারীর সমপরিমাণ পাপ কাবিলের আমলনামায় লিখিত হবে। কেননা, হত্যার মতো ভয়ংকর পাপ এ পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কাবিল দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। এবং তা নারীকে কেন্দ্র করে। হাবিল হত্যাকান্ডের সময় আদম (আঃ) মক্কায় ছিলেন। ফিরে এসে কাবিল হাবিল কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কাবিল ও হাবিলের মধ্যে কি কারণে দ্বন্দ্ব ছিলো, পিতা আদম তা জানতেন। ফেরেশতা জিব্রাইল (আঃ) আদমকে কাবিল কর্তৃক হাবিল হত্যাকান্ডের ঘটনা শুনলেন। হাবিলের মৃত্যুর স্থান চিহ্নিত করে দেয়ার পর আদম (আঃ) হাবিলের লাশ উঠালেন মাটি খুঁড়ে। দেখলেন হাবিলের মাথাটি আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। লাশ বাসস্থানে নিয়ে গেলেন। ফেরেশতা জিব্রাইলের গায়েবি নির্দেশে আদম (আঃ) হাবিলের লাশ গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে জানাযা আদায় করে ঘরের প্রাঙ্গণে কবরস্থ করলেন। “যে কারণে হাবিল হত্যাকান্ড” হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া তিনশত বছর পর সাক্ষাতলাভ করেন।
বর্তমান সিংহল দ্বীপে বসবাস শুরু করেন তাঁরা। বিবি হাওয়া অন্তঃসত্ত্বা হলেন। একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান মানে যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করলো। পুত্রের নাম কাবিল ও কন্যার নাম আকলিমা রাখা হলো। আবারও হাওয়া অন্তঃসত্ত্বা হলেন। এবারও এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান প্রসব করলেন হাওয়া। পুত্রের নাম হাবিল ও কন্যার নাম রাখা হলো গাজা। চার সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হতে লাগলো। উল্লেখ্য আদমের মোট সন্তান ৩৩৯। আল্লাহর হুকুমে জিব্রাইল আদমকে বললেন, এক জোড়ার ছেলে অন্যজোড়া কন্যার মধ্যে বিবাহদান। কিন্তু একই জোড়ার পুত্রকে কন্যার মধ্যে বিবাহ না দিতে আল্লাহর হুকুম পৌঁছে দিয়ে গেলেন জিব্রাইল। আল্লাহর নির্দেশের কথা কাবিল ও হাবিলকে অবহিত করলেন পিতা আদম। কিন্তু কাবিল এতে রাজী নয়, বলে জানায় পিতাকে। নির্দেশ মতো হাবিলের সঙ্গে সুন্দরী সুশ্রী আকলিমার ও কাবিলের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত অসুন্দরী গাজার বিয়ে হওয়ার কথা। বয়সের দিক টেনে কাবিল তারই জোড়ার বোন আকলিমাকে বিয়ে করতে চাইলো। পিতা আদম (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করতে অপারগতা স্বীকার করলে বড় পুত্র কাবিল বলেন, তুমি হাবিলকে বেশি ভালোবাসো বলেই সুন্দরী আকলিমাকে বিয়ে দিতে চাও, আর কুশ্রী গাজাকে আমার গলায় ঝুলাতে চাও। কাবিলের হুমকি ধামকি ভ্রুক্ষেপ না করে হাবিলের সঙ্গে আকলিমার বিয়ে দেয়া হলো। কাবিল বিয়ে হয়ে যাবার পরও আকলিমাকে পরিত্যাগ করার জন্য নানারকম হুমকি দিলো হাবিলকে। কিন্তু হাবিল রাজী হলো না। কাবিলের বাড়াবাড়ি থামলো না। সে হাবিলকে হত্যা করে আকলিমাকে বিয়ে করার কুচিন্তা মাথায় ঢুকালো। সে সুযোগ খুঁজতে থাকলো। পিতা আদম গেলেন মক্কা শরীফ। একদিন হাবিল বকরি ও মেষপাল চরাতে গেলো। কাবিল তা দেখে তার পিছু ছুটলো। মাঠের একপ্রান্তে গাছের ছায়ায় ক্লান্ত হাবিল ঘুমিয়ে পরেছিলো। কাবিল ভাবলো এই তো সুযোগ। হত্যা করতে হলে কিভাবে কোথায় আঘাত করতে হবে, তা তো জানা ছিলো না, কাবিলের। কেননা আগে তো কোনো হত্যার ঘটনা ঘটেনি। পিতার মুখে কাবিল শুনেছিলো, চিরশত্রু তাদের ইবলিশ। ইবলিশ একদিন কাবিলের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, মানুষের রূপ ধরেই। একটু পরে ইবলিশ একটা সাপ দেখলো এবং কাবিলকে দেখালো। ইবলিশের ঈশারায় সাপটি এগিয়ে আসলে ইবলিশ জমিন থেকে বড় একখন্ড পাথর উঠিয়ে হাতে নিলো। তারপর সাপের মাথার ওপর সজোরে নিক্ষেপ করলো। এক আঘাতেই সাপটি মরে গেলো। কাবিলের চোখের সামনেই ইবলিশ ঘটনাটি ঘটালো। কাবিলের হত্যার কৌশল শিখে ফেললো। ঠিক হাবিল যখন মাঠের কোনে গাছের ছায়ায় ঘুমাচ্ছিলো তখন, কাবিল তার মাথার ওপরে সজোরে পাথর নিক্ষেপ করলো। পৃথিবীতে সংঘটিত হলো প্রথম হত্যা। প্রসঙ্গত বিভিন্ন মত থাকলেও ধরে নেয়া হয় যে, প্রথম মানব আদম (আঃ) ৯৬০ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
Leave a Reply