আগের পর্বে আমরা বঙ্গবন্ধুর ভ্রমণবিষয়ক লিখেছিলাম। সাংগঠনিক কাজে, দেশ গড়ার কাজে তিনি কত হাজার মাইল ভ্রমণ করেছেন- এর কি কোনো হিসাব করা হয়েছে? নমুনা হিসেবে আমরা তার ১৯৫২ সালের উত্তরবঙ্গ সফরের একটি দীর্ঘ তালিকাও দিয়েছিলাম। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি অনেককেই চিঠি লিখেছিলেন। সারাজীবনে তিনি মোট কতটি চিঠি লিখেছেন, এর হিসাব আমার জানা নেই। মোট কতটি চিঠি সংগ্রহে আছে, তাও জানি না। তার কোনো চিঠিসমগ্র সংকলন প্রকাশিত হয়েছে- এমন নজিরও আমার চোখে পড়েনি। ওই ১৯৩৯ সাল থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার নিয়মিত পত্রবিনিময় হতো।
পরে মওলানা ভাসানীসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সঙ্গেই তার পত্র যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। অনেকে তার কাছে চিঠি লিখেছেন। দীর্ঘ কারাজীবনে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। গোয়েন্দারা সেসব চিঠি সংগ্রহে রেখেছেন। আমাদের ভাগ্যই বলতে হবে, তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চিঠি উদ্ধার করা গেছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ধারাবাহিকভাবে সেগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। এসব চিঠিপত্রেও তার রাজনৈতিক জীবনের অনেক খুঁটিনাটি বর্ণনা আছে। এর মধ্য দিয়ে একজন মানুষকে, একজন জনদরদি নেতাকে আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। আমাদের ধারাবাহিক এ লেখায় তার প্রেরিত ও প্রাপ্ত কিছু চিঠি নিয়ে আলোচনা করা যাক। একেবারে তৃণমূলের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তিনি চিঠি পেতেন।
বিভিন্নজনের কাছে লেখা শেখ মুজিবের কিছু চিঠি আমরা এর আগে প্রকাশ করেছি। প্রসঙ্গক্রমে পরবর্তী লেখাগুলোয় আরও কিছু চিঠির উল্লেখ থাকবে। আজ শেখ মুজিবের কাছে তিন সাধারণ্যের তিনটি অসামান্য চিঠি প্রকাশ করছি। ১৯৫০ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যখন জেলে, তখনই তার কতখানি জনপ্রিয়তা ছিল এবং মানুষ তাকে কতখানি ভালোবাসত, সেটি বোঝা যায় জেলখানায় আসা দুটি চিঠি থেকে।
একটি চিঠি লিখেছে শেখ মুজিবের গ্রাম গিমাডাঙ্গা হাইস্কুলের ছাত্ররা। ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বরে আসা এ পত্রে ছাত্ররা লিখেছে, ‘জোনাব নেতা সাহেব পর সমাচার প্রায় ৮-৯ মাস গত হয় আপনী জেলে গিয়াছেন তাহাতে আমওরা আপনার সুসংবাদআদি না পাইয়া যার পর নাই চিন্তাযুক্ত আছি। আশা করি আপনী আপনার কার্য্যরে জন্য বেতীব্যস্ত আছেন যা হোক সে কার্য্য একদিন না একদিন জয়ই হইবেই, তাহার জন্য চিন্তা করিবেন না বা দৈর্য্য হারাইবেন না আমরা ছাত্রবৃন্দ আপনার সব কার্জ্য প্রায় সমাধান করিয়া আনিয়াছি, তাহার জন্য আপনী চিন্তা করিবে না। আপনী এবৎসর গোপালগঞ্জে মোহকমার একজন এম এল সাহেব হইবেন, এই আসাতে আমরা ছাত্রবৃন্দ এক সভা করিয়া সেই সভায় হিন্দু মুসলমান সবাই এক বাক্যে সিকার করেছেন যে মুসলীম নেতা মুজিবর রহমানের জন্য আমারা প্রাণপণে প্রার্থনা করি যাহাতে দেশের ও দুঃখ দীনের অভাব অভিযোগ না থাকে তাহার জন্য প্রাণ দিতে আমরা রাজী, চাই গরিবের দুঃখ মছোন করিতে আমারা চাই জাতী ও দেশকে বাচাইতে আমরা চাই জগতের সম্মুখে জাতীয় গৌরব রক্ষা করিতে তাহাতে আমরা জীবন দান করিব তাহার জন্য আপনী কোনই চিন্তাযুক্ত হইবেন না আল্লা আমাদের সহায় আছে ভয় কি আছে। হবে হবে জয় জয় থাকবে গাথা হৃদয় মাজে তোমার প্রেমের ভালবাসা পাকিস্তান মুক্তির মাস জিন্দাবাদ, মুসলিম নেতা জিন্দাবাদ আওমই মুসলিম লীগ কি জয়ো জয়ো জয়ো জয়ো…’ (পৃষ্ঠা ৫০০-৫০১, ভলিউম-১)।
একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, চিঠিটিতে ছেলেমানুষি আবেগে ভরপুর, অনেক বানান ভুল। ভালোবাসার যে আবেগ, সেটি মিথ্যা নয়। গিমাডাঙ্গা হাইস্কুলের ছাত্রদের পক্ষে চিঠির প্রেরকের নাম ছিল ‘ছরওয়ার’।
দ্বিতীয় চিঠিটি লিখেছেন গোপালগঞ্জ থেকে অজ্ঞাতনামা একজন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্বোধন করছেন ‘খোকা’ বলে। শেখ মুজিব যেন দ্রুত ছাড়া পান, ওই প্রার্থনা জানিয়ে বলেছেন- we are in quite darkness about your present modes of living. if money can add you any comfort in your present life, please do not forget write to poor man.For God sake you inform me (6 october 1950, 298 number report, page 511, volume-1).
এটুকু পড়েই বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ তখন কতখানি উদ্বিগ্ন ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বিষয়ে। কতখানি ভালোবাসা থাকলে জেলখানায় তাকে টাকা পাঠাতে চান। উল্লেখ্য, শেখ মুজিবুর রহমান তখন ছোট ছোট দুই সন্তানের পিতা। এ কথাও নিশ্চয়ই চিঠির প্রেরক জানতেন। চিঠি পড়ে মনে হয়, তিনি মুরুব্বিশ্রেণির কেউ এবং শেখ মুজিবকে কাছ থেকে চিনতেন। দুঃখের ব্যাপার, তার নাম-পরিচয় জানা যায়নি। গোয়েন্দা প্রতিবেদগুলোর মাধ্যমে তার এই ভালোবাসা অমর হয়ে রইল।
১৯৫২ সালের ৬ ডিসেম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এসেছে আরও এক সাধারণ মানুষের চিঠি-
“জনাব
আমার ছালাম গ্রহণ করিবেন। আমি যদিও আপনার সহিত পরিচিত নই তবুও আমি আপনাকে একজন মহৎ দেশ্রপ্রেমিক হিসাবে ভক্তি করি। আপনার কর্তব্য জ্ঞান স্বদেশ সেবা বিরাট ব্যক্তিত্ব, নির্ভীক বক্তৃতা নানা রকম ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যেও কর্তব্য কর্ম্মে দৃঢ়ভাবে অবিচল অটল থাকা, দেশের জন্য বারংবার কারাববরণ প্রভৃতি মহৎগুণে আমাকে শুধু আমাকে কেন দেশের অধিকাংশ জনসাধারণকেই মুগ্ধ করিয়াছে। অবশ্য ছয় বৎসর পূর্বের ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে গত নির্ব্বাচনের সময় বোয়ালমারী বাজারে আপনার প্রতিভা দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলাম এবং তখনই আমার সহকর্ম্মী হইব বলিয়া হৃদয়ে আশা পোষণ করিয়াছিলাম। যদিও আমি মুসলিম লীগের একজন নগণ্য খাদেম হিসাবে এ যাবৎ কাজ করিয়া আসিতেছিলাম: কিন্তু মুসলিম লীগের কার্য্যকলাপে আমি কোন দিনই সন্তষ্ট হইতে পারি নাই। কারণ আমি বুঝি যেটা মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সেখানে প্রত্যেক মুসলমানের প্রবেশাধিকার থাকিবে না কেন?
মুসলিম লীগের উপর এখন আর জন সাধারণের আস্থা নাই। আছে শুধু মুষ্টিমেয় কয়েকজন স্বার্থপর ও দালাল লোকদের। আপনাদের প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের উপর এখন অনেকেই আস্থা স্থাপন করিয়াছে। কিন্তু প্রকাশ্যে ঘোষণা করিবার সৎ সাহস এখনও এদেশবাসীর হয় নাই। কি জানি যদি গভর্নমেন্টের অতিথি হইতে হয়। আমি বর্ত্তমানে আমাদের সাপ্তাহিক কাগজ ইত্তেফাক এর গ্রাহক হইয়াছি। উক্ত কাগজ মারফত জানিতে পারিলাম আগামী ২৫ শে ডিসেম্বরের মধ্যে আগওয়ামী লীগের মহকুমা সমূহের নির্ব্বাচন সম্পন্ন করিতে হইবে। আমাদের ফরিদপুর জেলার সদর মহকুমার নির্ব্বাচন সম্পন্ন হইয়াছে কি না জানি না। কি ভাবে ঐ নির্ব্বাচন হইবে এবং আমাদিগকে কি ভাবে কাজ করিতে হইবে তাহা অবশ্যই পত্র পাওয়া মাত্র জানাইয়া দিবেন।
অবশ্য ২৫ ডিসেম্বরের পূর্ব্বে আপনি একবার বোয়ালমারী আসিলে সব ঠিক হইয়া যাইত। যদি আসিতে পারেন তবে আমাকে পত্র দ্বারা জানাইবেন। আমি সব ব্যবস্থা করিব। ইনশাল্লাহ আমরা আগামী ইলেকশনে জয়লাভ করিতে সমর্থ হইব। আমার মনে হয় যদি আপনার প্রত্যেক থানায় থানায় ঘুরিয়া সভা করিতে পারেন তবে সবগুলি আসনই আমরা দখল করিতে সমর্থ হইব। আপনাদের শুধু টাউনে টাউনে বক্তৃতা করিয়ে চলিবে না। পাড়াগায়েও নামিয়া আসিতে হইবে। কারণ পাড়াগায়ের লোক এখনও অজ্ঞ। তাহা দিগকে সব কিছু বুঝাইয়া মর্ম্মে মর্ম্মে উপলব্দি করাইয়া দিতে হইবে। আপনারা প্রথমে সদস্য সংগ্রহ আরম্ভ করুন। তাহার পর নির্ব্বাচন সম্পন্ন করিবেন।
নইলে পকেট লীগের মত দশা হইয়া যাইবে। আপনি বোধ হয় আমাকে চিনেন না। তবে খুব সম্ভব বোয়ালমারীর আবু ছাইদ মিয়াকে চিনেন। তিনি আমার ভাই। এই আমার পরিচয়। আশা করি আপনাদের একজন নগন্য খাদেম হিসাবে মুসলমান সমাজের খেদমত করিতে পারিব। আশা করি আমি আপনাদের একজন সহকর্ম্মী হিসাবে আপনাদের স্নেহাশীষ পাইব। ইতি
খাকছার
স্বাঃ- এম, এ গফুর
ছোলনা, পোঃ বোয়ালমারী
ফরিদপুর’ (ভলিউম-২, পৃষ্ঠা- ৪৯৬-৪৯৭)।
এতেই বোঝা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান তখনই জনগণের মনে কতখানি জায়গা পেয়ে গিয়েছিলেন। মানুষ তাকে নিয়ে কতটা ভাবছে? কীভাবে তিনি বাংলার সাধারণ মানুষকে মুসলিম লীগ থেকে বের করে এনে আওয়ামী লীগের কর্মী বানিয়েছেন- তা একদিনে হয়নি, খুব সহজে হয়নি। এ জন্য তিনি শুধু জেলায় জেলায় বক্তৃতা করেননি। জনগণের ডাকে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রতিটি থানায় থানায়, গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে। পুরো বাংলাদেশটিকেই তিনি ধারণ করেছিলেন। তাই বাংলাদেশের আরেক নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
(চলবে)
ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
Leave a Reply