বরগুনা প্রতিনিধি ॥ সরকারের অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (৪০ দিনের কর্মসূচি)-এর টাকা লোপাট করে খাচ্ছেন বরগুনার পিআইও। কর্মহীন মৌসুমে দুস্থ পরিবারের স্বল্প মেয়াদী কর্মসংস্থান এবং গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি টাকা ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ দিয়ে লোপান করছে দুষ্ট চক্র। এই লোপাট চক্রের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করছেন বরগুনার পিআইও মফিজুর রহমান। পিআইও মফিজুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের সর্বত্রই নাকি এমনটাই চলছে! পিআইও মফিজের নেতৃত্বে এ টাকার নির্দিষ্ট পরিমান ভাগ চলে যায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে। দুর্নীতির এমন চিত্র বেরিয়ে এসেছে কালেরকণ্ঠের সরেজমিন অনুসন্ধানে। পিআইও মফিজুর রহমান মূলত বরগুনার আমতলী উপজেলার মূল দায়িত্বে এবং সদর উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন। বরগুনা সদর উপজেলার পিআইও মফিজুর রহমানের অফিসে লাখ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেনের একটি ভিডিওচিত্র পাওয়া গেছে। সেখানে পিআইও মো. মফিজুর রহমান ও তার অফিস সহায়ক (পিওন) গোলাম মোস্তফা বাচ্চুকে ইজিপিপি প্রকল্পের লাখ লাখ টাকা গুনে নিতে দেখা গেছে। সেখানে দেখা গেছে পিআইও অফিস পিওন গোলাম মোস্তফা বাচ্চু দায়িত্ব পালন করছেন ঘুষ আদান প্রদানের হিসাবরক্ষক হিসেবে। একই ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে হঠাৎ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মোটা অংকের ঘুষের টাকা দ্রুত অফিসের আয়া রাণী বেগমের হাতে দিয়ে কোথাও গোপনে সরিয়ে রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন অফিস সহায়ক বাচ্চু। ভিডিও চিত্রে শোনা গেছে, পিআইও মফিজুর রহমান বলছেন, শুধু বরগুনা নয়, জেলার আমতলী, তালতলী, বামনা, পাথরঘাটা, বেতাগীসহ সারা বাংলাদেশেই এই একই নিয়মে চলছে এ প্রকল্পের কাজ।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ প্রকল্পের অধীনে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে শুধুমাত্র বরগুনা সদর উপজেলা থেকে এ চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। এ অর্থবছরে সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে মোট ২৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যার মোট ব্যায় ধরা হয়েছে ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ ৪০ কর্ম দিবসে এক হাজার ১৬৭ জন শ্রমিকের অনুকূলে যেখানে মোট বিল দেখানো হয়েছে ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এ হিসেবে প্রতিদিন এক হাজার ১৬৭ জন শ্রমিকের অনুকূলে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরি হারে বিল হয় দুই লাখ ৩৩ হাজার ৪০০ টাকা। সরেজমিন পরিদর্শন, সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী এবং ক্ষুব্ধ ইউপি সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সদর উপজেলার ৪০ দিনের মোট কাজের ২০ দিনের এক হাজার ১৬৭ জন শ্রমিকের অনুকূলে বরাদ্দকৃত টাকার ৪৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা সুকৌশলে চলে যায় পিআইও মো. মফিজুর রহমানের হাতে। যার নেতৃত্বে এসব টাকা ভাগ হয়ে চলে যায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ৪০ কর্ম দিবসের ২০ দিনের শ্রমিক মজুরীর বাকি ৪৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতিগণ, যারা এ প্রকল্পসমূহ মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করেছেন। এসব টাকার মধ্য দিয়ে নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট অংকের একটি লাভ রেখে তারপর বাকি টাকা খরচ করেন তারা প্রকল্পের কাজে।
পিআইও মফিজুর রহমানের একটি ভিডিও রেকর্ডে তাকে বলতে শোনা গেছে, শুধু বরগুনায় কেন বরগুনার অন্যান্য উপজেলাসহ সারা বাংলাদেশে যেভাবে হয় বরগুনায়ও তেমনি হবে। অন্যদিকে সদর উপজেলার ফুলঝুড়ি ইউনিয়নের একজন ইউপি সদস্য মো. জাকির হোসেন মল্লিক বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত মহৎ একটি প্রকল্প হচ্ছে এই ইজিপিপি প্রকল্প। অসহায় কর্মহীন দুস্থদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি গ্রামীন অবকাঠামো মেরামত ও পূণনির্মানের জন্য এ প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ৪০ কর্মদিবসের মধ্যে ২০ দিনের শ্রম মজুরীই তাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. গোলাম কিবরিয়া পিআইও অফিসের কথা বলে রেখে দিয়ে বাকি টাকা দেন সংশ্লিষ্ট সিপিসি বা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতির কাছে। এতে একটি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার অর্ধেক টাকা দিয়ে বাধ্য হয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সিপিসিকে। এতে কাজের গুনগত মান যেমন ঠিক থাকছে না। তেমনি বঞ্চিত হচ্ছে কর্মহীন দুস্থ শ্রমিকরা। আর এসব বিষয়ে সাধারণ ইউপি সদস্যদের কিছুই জানতে দেন না চেয়ারম্যান মো. গোলাম কিরিয়া। এমন অভিযোগ করেছেন, একই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো নাসিরুদ্দিন সেন্টু, মীর শামসুল আলম জিউ এবং তরিকুল ইসলাম টুটুলসহ আরও অনেকে। যার ভিডিও ফুটেজ রয়েছে কালেরকণ্ঠের কাছে।
সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের ৮নম্বর ওয়ার্ডের জাকিরতবক ওয়াপদা হতে খালের উত্তরপার দিয়ে পূর্ব দিকে ছালামের দোকান পর্যন্ত রাস্তা পুনঃনির্মাণ কাজের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার টাকা, অথচ বাস্তবে সেখানে তার তিনভাগের একভাগ টাকারও কাজ হয়নি। একই চিত্র দেখা গেছে সদর উপজেলার আরও একাধিক প্রকল্প পরিদর্শন করেও। কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের ৮নম্বর ওয়ার্ডের জাকিরতবক এলাকার কাজের মান সম্পর্কে স্থানীয় এলাকাবাসী মিনারা বেগম (৫৮) বলেন, রাস্তার কাজে সামান্য মাটি ফেলে সামান্য কাজ করেছে। তবে কোথাকার শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয়েছে তা আমরা জানি না। সবমিলিয়ে ২০ দিনের মত কাজ করেছে বলেও তিনি জানান। একই এলাকার স্থানীয় এলাকাবাসী ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলচালক রাসেল (৩২ ) মিয়া জানান, যেখানে উচু সেখানের মাটি কেটে নিঁচু জায়গায় ফেলেছে, বাইরে থেকেও সামান্য কিছু মাটি দিয়েছে। তবে এখানে যে কাজ হয়েছে তার মূল্য এক লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি হবে না অথচ আমরা জেনেছি যে এই কাজের জন্য চার লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। স্থানীয় এলাকাবাসী মো. ছগির হোসেন (৩০) জানান, একই সড়কে একটি ইউড্রেন কালভার্ট নির্মাণের জন্য ৩৮ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোন কাজ না করেই তা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইজিপিপি প্রকল্পের নিয়মানুযায়ী প্রতিটি প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দকৃত অর্থ ৪০ দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক দুস্থ শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে দিতে হয়। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি থাকে। এ কমিটির সভাপতি হন সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্যরা। এই কমিটিই মূলত মাঠপর্যায়ে কাজ বাস্তবায়ন করেন। শ্রমিকের শ্রমমূল্য প্রতিটি শ্রমিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়ে থাকে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ প্রকল্পে প্রথম দুর্নীতিটা হয় শ্রমিক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। শ্রমিক হিসেবে নিজেদের পছন্দের বিশ্বস্ত লোকজন বাছাই করা হয়। তারপরে বাছাইকৃত প্রতিটি শ্রমিকের নামে নির্দিষ্ট কোন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করা হয়। বরগুনা সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সোনালী এবং জনতা ব্যাংককে। এই অ্যাকাউন্ট করার পর চেক ইস্যু হওয়ার সাথে সাথেই বিশ্বস্ত শ্রমিকদের কাছ থেকে স্বাক্ষর করা একাধিক আগাম চেক নিয়ে নেয় পিআইও ও তাঁর চক্রের লোকজন।
এ বিষয়ে সদর উপজেলার ফুলঝুরি ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। সকল ইউপি সদস্যকে তো খুশি রাখা যায় না। সবাইকে তো কাজ দেওয়া যায় না। তাই অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে এসব কথা বলতে পারেন বলে জানান তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিআইও মফিজুর রহমান এর আগে যেখানেই চাকরি করেছেন সেখানেই এমন অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এসব অনিয়ম দুর্নীতির কারণে তার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে বলেও একটিসূত্রে জানা গেছে। ৪০ দিনের কাজের ২০ দিনের অর্থলোপাটের অভিযোগ এবং ঘুষ লেনদেনের ভিডিও চিত্রের বিষয় জানিয়ে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন বরগুনা সদর উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা পিআইও মফিজুর রহমান। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘুষ লেনদেনের এসব অভিযোগ ওঠার পর বরগুনা সদর উপজেলার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে চাইছেন পিআইও মফিজুর রহমান এবং তিনি এখন আর বরগুনায় অফিস করছেন না। বরগুনা পিআইও অফিসের অধীনস্থ কর্মচারীগণ জরুরি সকল ফাইল আমতলী যেয়ে তার স্বাক্ষর আনেন। এ বিষয়ে বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা আক্তার বলেন, পিআইও মফিজুর রহমানের বিষয়ে এরকম একাধিক অভিযোগ শুনেছি, তিনি ভাল মানুষ নন। তার ব্যাপারে শিঘ্রই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, তাঁর কাছে এখনও কোন অভিযোগ আসেনি। তবে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখবেন তিনি। ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে অবশ্যই যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Leave a Reply