করোনাকালে মাস্ক ও পিপিই ক্রয়ে দুর্নীতিসহ জেকেজি হেলথ কেয়ার ও রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিতে অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগগুলো অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের অনুসন্ধানে ফেঁসে যেতে পারেন সদ্য পদত্যাগকারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ও তার অনুসারী পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল ইসলামসহ বেশ কয়েক কর্মকর্তা।
দুদক জানায়, করোনা চিকিৎসাকাজে ব্যবহারের জন্য নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্য মেডিক্যাল সরঞ্জাম সরবরাহের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ছাড়াও লাইসেন্সবিহীন রিজেন্ট হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসা ও নমুনা সংগ্রহের অনুমোদন দেওয়া হয়। জেকেজি হেলথ কেয়ার নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে নমুনা সংগ্রহের অনুমোদন প্রদানেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছে দুদক। এসব অভিযোগের সাথে যারা জড়িত তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মামলা করা হবে।
অভিযোগ রয়েছে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই নকল এন-৯৫ মাস্ক কিনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরস ডিপো (সিএমএসডি)। এর পর অভিযোগ ওঠে করোনার চিকিৎসাসেবা ও নমুনা সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত হওয়া রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজিকে অনুমোদন
প্রদানে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ও পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক)। তারা লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করেন এবং জেকেজির মালিক আরিফ চৌধুরীকে অর্থ আদায়ের সুযোগ করে দিয়েছেন।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুভার্বের শুরুতেই নকল এন-৯৫ মাস্ক কিনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সিএমএসডি। মাস্ক ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালককে সরিয়ে নতুন পরিচালক নিয়োগ করা হয়। এরপর পিপিই ও যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন মেডিক্যাল সরঞ্জাম ক্রয় করে হাসপাতালগুলোয় সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্জন করেছে এমন অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। কমিশন অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করতে দুদকের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীকে প্রধান করে চার সদস্যের অনুসন্ধানী দল গঠন করেন।
অনুসন্ধানী দলের প্রধান গত ২১ জুন অনুসন্ধানের স্বার্থে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সিএমএসডির পরিচালককে মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজার, আইসিইউ যন্ত্রপাতি, ভেন্টিলেটর, পিসিআর মেশিন, কোভিড টেস্ট কিট ও অন্য সামগ্রী ক্রয়ে গৃহীত প্রকল্পগুলোর নাম, বরাদ্দ করা ও ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ এবং বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়ে চিঠি দেন। চিঠিতে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে চাহিত তথ্য ও রেকর্ডপত্র সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। দুদকের ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ সংক্রান্ত নথিপত্র দুদকে পাঠানো হয়।
দুদকের জনসংযোগ শাখা জানায়, অভিযোগ সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনা শেষে গত ১ জুলাই অনুসন্ধানী দলের প্রধান মাস্ক, পিপিই ও যন্ত্রপাতি সরবরাহের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান মেসার্স জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রাজ্জাক, তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোং লিমিটেডের সমন্বয়কারী (মেডিক্যাল টিম) মো. মতিউর রহমান এবং এলান করপোরেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম আমিন ৮ জুলাই এবং লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ও টেকনোক্র্যাট লিমিটেডের মালিক মো. মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু, মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেডের পরিচালক মো. হুমায়ুন কবিরকে ৯ জুলাই রেকর্ডপত্রসহ দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য বলা হয়।
জানা গেছে, গত ৮ জুলাই দুদকে জেএমআইয়ের মো. আব্দুর রাজ্জাক ও তমা কনস্ট্রাকশনের মো. মতিউর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুদক সচিব দিলোয়ার বখত বলেছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মাস্ক-পিপিই দুর্নীতির সঙ্গে কারা জড়িত সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অনুসন্ধান পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যাদের নাম আসবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মাস্ক দুর্নীতিতে সরকারি কোনো কর্মকর্তা জড়িত আছে কিনা তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনুসন্ধানের স্বার্থে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কারও নাম জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এলে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান টিম কাজ করছে।
রিজেন্ট হাসপাতালের দুর্নীতি : প্রতারণা, জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে রিজেন্ট হাসপাতাল মালিক সাহেদ করিম কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছে বলে অভিযোগ পেয়েছে দুদক। অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. আবু বকর সিদ্দিক। তিনি অভিযোগ অনুসন্ধানের স্বার্থে গত ১৩ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ নয়টি প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠান। অভিযোগ সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনা শেষে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে।
অভিযোগ রয়েছে, করোনার রোগীর চিকিৎসা প্রদানে রিজেন্ট হাসপাতাল গত ২১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। রিজেন্ট হাসপাতালের সাথে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তির মূলে ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল ইসলামসহ ওই শাখার কয়েক কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। হাসপাতালটির লাইসেন্স না থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল ইসলাম পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব তথ্য গোপন করে চুক্তির পথ তৈরি করেন। র্যাবের অভিযানের বিষয়টি ধরায় এবং রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিম গ্রেপ্তারের পর ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। তাদের মদদে প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে করোনার নমুনা পরীক্ষা না করে অর্থ আদায় ও রোগীর কাছ থেকে চিকিৎসা ব্যয় আদায়ের পরও সরকারের কাছ থেকে চিকিৎসা ব্যয় আদায়ের মাধ্যমে কোটি কোটি আত্মসাৎ করে।
করোনার পরীক্ষা না করে রিপোর্ট প্রদানসহ রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ৬ জুলাই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) একটি দল রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরায় শাখায় অভিযান চালায়। অভিযানকালে অনিয়মের সত্যতা পাওয়ায় পর হাসপাতালের উত্তরা শাখা সিলগালা করে দেয় র্যাব। একই দিন রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর অভিযান চালিয়ে অনিয়মের অভিযোগে সিলগালা করে দেওয়া হয়।
জেকেজি হেলথ কেয়ার দুর্নীতি : জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধরীর দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপ-পরিচালক সেলিনা আখতার মনি। তিনি অভিযোগ সংক্রান্ত নথিপত্র চেয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছেন। নথিপত্র সংগ্রহের পরই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদে বা নথিপত্রে অভিযোগের সাথে কারও জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
অভিযোগ রয়েছে, জেকেজি হেলথ কেয়ারের মালিক আরিফ চৌধুরী ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী ২৭ হাজার করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেন। এর পর কোনো পরীক্ষা ছাড়াই ১৫ হাজার ৪৬০টি ভুয়া রিপোর্ট দেন। আর বাকি ১১ হাজার ৫৪০টি রিপোর্ট আইইডিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। করোনার ভুয়া মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রস্তুত ও সরবরাহ করে ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি অনুমোদনের আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিজেই পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির করোনার নমুনা সংগ্রহের সুযোগ দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দায়ী করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তা। জেকেজির অনুসন্ধানে তার নাম উঠে এলে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
সাময়িক বরখাস্ত হচ্ছেন হাসপাতাল শাখার পরিচালক
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদত্যাগের পারই অধিদপ্তরের পরিচালক, উপ-পরিচালকসহ বেশি কয়েক কর্মকর্তাকে বদলি ও সাময়িক বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল ইসলামকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জেকেজি হেলথ কেয়ারকে করোনার চিকিৎসার সঙ্গে যুক্তকরণ নমুনা সংগ্রহের অনুমতি প্রদানের সঙ্গে তার জড়িত থাকায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আজকালের মধ্যেই তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে আদেশ জারি হতে পারে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জেকেজি হেলথ কেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। এ কারণে সরকারের শীর্য পর্যায় থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংস্কারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমপক্ষে এক ডজনেরও বেশি কর্মকর্তার তালিকা তৈরি করা হয়। যাদের ক্রমন্বয়ে বদলি কিংবা সাময়িক বরখাস্ত করা হবে।
Leave a Reply