আবাসস্থল ও খাদ্য সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চোরা শিকার ইত্যাদির কারণে এমনিতেই সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমেছে। তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বনের আশপাশে শিল্প কারখানার দূষণ ও পুরুষ বাঘের সংখ্যা কম থাকায় প্রজনন সংকটে পড়েছে সুন্দরবনের রাজা। ফলে প্রতি বছরে গড়ে ৫টি বাঘ কমলেও সে তুলনায় নতুন বাঘ জন্ম নিচ্ছে না। এমন অবস্থায় ২০৭০ সালের মধ্যে সুন্দরবন থেকে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে সতর্কতা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রাণী গবেষণা সংস্থা ট্রাফিকের মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছরে গড়ে ৩টি বাঘ মারা যায় চোরা শিকারিদের হাতে। এভাবে গত ২০ বছরে অন্তত ৫১টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে পাচারের উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০০৪ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। ২০১৮ সাল নাগাদ সেই বাঘের সংখ্যা হয়েছে ১১৪টি। অর্থাৎ ১৪ বছরে বাঘের সংখ্যা কমেছে ৩২৬টি। চলতি বছরে এরই মধ্যে ২টি বাঘ মারা গেছে। তবে ২০২০ সালে এসে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমেছে না বেড়েছে সে সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেনি সংস্থাটি। বাংলাদেশের প্রধান বন সংরক্ষক সফিউল আলম চৌধুরীর বলেন, ২০১৫ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘ ছিল ১০৬টি। পরে বন বিভাগের বাঘ গণনায় পাওয়া গেছে ১২২টি। তার মতে, বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা এখন বেড়ে ১৩০ এর কাছাকাছি হয়েছে।
এর আগে গত বছরের ১৪ মে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার গবেষকদের এক সমীক্ষায় সতর্ক করা হয়েছিল, সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে। ওই সমীক্ষাটি টোটাল এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স নামের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা হয়, গোটা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে বঙ্গোপসাগরে। সুন্দরবনেও এর প্রভাব পড়ছে। এ অঞ্চলের ৭০ শতাংশ ভূমি সমুদ্রের উপরিভাগের মাত্র কয়েক ফুট ওপর। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকায় বনের জমি স্থায়ীভাবে ডুবে যাওয়ার শঙ্কা বাড়ছে। এ ছাড়া দূষণসহ নানা কারণে কমে আসছে বাঘের প্রজনন ক্ষেত্র। একই সঙ্গে আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না বাংলার বাঘ। ফলে কমছে এর প্রজনন ক্ষমতাও। প্রাণী বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ৩টি বাঘিনীর বিপরীত একটি পুরুষ বাঘের প্রয়োজন সঠিক প্রজননের জন্য। কিন্তু শরণখোলায় প্রতি ৯টি বাঘিনীর বিপরীতে একটি পুরুষ বাঘ পাওয়া যায়। সাধারণত দুই বছর পরপর বাঘিনী নতুন শাবক জন্ম দেয় এবং প্রায় দেড় বছর লালন পালন করে। কিন্তু পুরুষ বাঘের সংকট থাকায় জন্ম দেওয়ার বিরতি আরও বেশি বলে জানায় বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা। এ ছাড়া খাদ্য সংকটে থাকলে পুরুষ বাঘের শাবক খেয়ে ফেলাও বিরল নয়। বাঘের প্রথাগত খাদ্য সংকট থাকায় তারা লোকালয়ে প্রবেশ করছে। যার ফলে গণপিটুনিতে মারা পড়ছে।
বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ ও বন্য শূকর। আগে ছিল মহিষ। এখন সুন্দরবনে তা নেই বললেই চলে। বর্তমানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ৬০ হাজার থেকে কিছু বেশি হরিণ থাকতে পারে। সাধারণত পাঁচশ হরিণের জন্য একটি করে বাঘ থাকে। সেই হিসেবে সুন্দরবনে ১২০টির মতো বাঘ থাকতে পারে।’
বনবিভাগ বলছে, সুন্দরবনে বাঘসহ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল বৃদ্ধি করা হয়েছে। মোট ছয় লাখ এক হাজার ৭০০ হেক্টর বনের মধ্যে এখন তিন লাখ ১৭ হাজার ৯০০ হেক্টর অভয়ারণ্য এলাকা। আগে যা ছিল মাত্র এক লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর। ২০১৭ সালে সরকার অভয়ারণ্য এলাকা সম্প্রসারণ করে। সুন্দরবনে বাঘের নিরাপত্তা নিশ্চিতে টহল ফাঁড়ির কার্যক্রমের পাশাপাশি স্মার্ট পেট্রল করা হচ্ছে। বাঘ যাতে সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে বের হতে না পারে এ জন্য বনের সীমানা এলাকায় বন বিভাগের টহল বাড়ানো হয়েছে।
Leave a Reply