জাল ঠেকাতে এরই মধ্যে কয়েক দফায় বড় অঙ্কের টাকার নোট পরিবর্তন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে জালটাকার কারবারিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেপ্তারকৃতদের শাস্তির আওতায় আনতে করা হচ্ছে মামলাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও জালটাকার কারবারিদের থামানো যাচ্ছে না। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সাক্ষীর অভাবসহ নানা দুর্বলতার কারণে সহজে আসামিরা খালাস পেয়ে আবার একই অপরাধে লিপ্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলাজটও বেড়েই চলেছে। ফলে অপরাধীরা বারবার সক্রিয় হয়ে বাজারে জালনোট ছড়াচ্ছে। আসন্ন কোরবানি ঈদ উপলক্ষে এবারো বাজারে জালনোট ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে একটি চক্র।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জালনোট তৈরি ও ছড়ানোর একাধিক চক্র রয়েছে। সর্বশেষ গত ৩০ জুন মিরপুর ও বসুন্ধরা এলাকা থেকে জালনোট তৈরির মেশিন ও জালটাকাসহ একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ ঘটনার কিছু দিন আগে খুলনা থেকে চার হাজার টাকার জালনোট, তিনটি কালার প্রিন্টার, একটি লেমিনেটিং মেশিন, একটি ল্যাপটপ, একটি টাকা তৈরির ডিজিটাল প্লেট, ছয়টি বোতলে (রিফিল) কালি এবং সাদা রঙের দুই বান্ডিল ট্রেস পেপারসহ একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই চক্রের অনেকের পেশাই জালনোট তৈরি ও ছড়ানো। গত জানুয়ারিতেও এমন দুজন কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জানা যায়, তারা ২০ বছর ধরে এই কাজে লিপ্ত। এই চক্রের সদস্যরা আগেও একাধিকবার ধরা পড়লেও জামিন পেয়ে একই কাজে লিপ্ত হন। জালনোটের কারবারের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি চক্রও জড়িত রয়েছে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে তাদের কয়েকজনকে আটক করে র্যাব-পুলিশ।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৪৮টি অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব ঘটনায় ৪৮টি মামলা হয়। গত ছয় মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে এ ধরনের ৩১ পুরনো মামলা। বেশিরভাগ মামলায় আসামিরা নানা কারণে খালাস পেয়ে যান। গত ৩০ জুন পর্যন্ত জালনোটের কারবারিদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৮৭টি। এর আগের বছরগুলোতে যে হারে নতুন মামলা হয়েছে, পুরনো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে অর্ধেকেরও কম। ফলে প্রতিনিয়ত জালনোটের মামলার জট বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে নতুন মামলা হয় ৩৪৪টি, আর নিষ্পত্তি হয় ১০৪টি। বছর শেষে পুঞ্জিভূত মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৩৩টি। পরের বছর ২২৭টি নতুন মামলার বিপরীতে নিষ্পত্তি হয় ১১৭টি। মামলার জট আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৫৪৩টিতে। ২০১৮ সাল জট বেড়ে পুঞ্জিভূত মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৬৭৩টি। ওই বছরে ১৮৮টি নতুন মামলা হলেও নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৫০টি। তবে পরের বছর ২০১৯ সালে নতুন মামলার চেয়ে নিষ্পত্তি বেশি হয়। ওই বছর ১৭৫টি নতুন মামলা হয় আর নিষ্পত্তি হয় ১৭৮টি মামলা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, ‘জালনোটের মামলাগুলো গঠিত টাস্কফোর্সের সভায় আলোচনা করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি আঞ্চলিক কমিটির সভায়ও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয়, যেন জালনোটের বিস্তার শূন্যে নামিয়ে আনা যায়। এখন বিদ্যমান আইনে বিচার চলছে। এই বিচারকে যুগোপযোগী করতে নতুন আইন করা হচ্ছে।’
জানা গেছে, জালনোটের বিস্তার রোধে পৃথক আইন করতে উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৯ সালে। ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সংক্রান্ত একটি খসড়া আইন অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত আইনটি পাস হয়নি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন ২০২০’-এর খসড়া চূড়ান্ত করে অংশীজনদের মতামত সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া দেশে জালনোট তৈরি ও ছড়ানো ঠেকাতে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। জাল করা ঠেকাতে ও আসল নোট চিহ্নিত করতে ১০০০ টাকার নোট সম্প্রতি দুবার পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন নোট জাল করা যেমন কঠিন, তেমনি সাধারণ মানুষের পক্ষে চেনাও সহজ।
এদিকে উৎসব উপলক্ষে যখন নগদ টাকার লেনদেন বাড়ে, তখন আরও বেশি সক্রিয় হন জালনোট কারবারিরা। আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে বর্তমানে সারাদেশে পশুর হাট বসেছে। এসব হাটে নগদ লেনদেন হয়। ফলে পশুর হাটে সাধারণ বিক্রেতাদের ঠকাতে তৎপর জালনোটের কারবারিরা। ইতোমধ্যে এই চক্রকে ঠেকাতে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জালনোট শনাক্ত করতে ব্যাংকগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, কোরবানির পশুর হাটে নগদ লেনদেন কেন্দ্র করে অপরাধীদের তৎপরতা ঠেকাতে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও রাজধানীসহ সব জেলা-উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ পশুর হাটে থাকবে জালনোট শনাক্তকরণ বুথ। ঈদের আগের রাত পর্যন্ত এসব বুথ থেকে বিনামূল্যে জালনোট শনাক্তকরণ সেবা দেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১২টি হাটে ১২টি বুথ এবং উত্তর সিটির ৬টি হাটে সাতটি জালনোট শনাক্তকরণ বুথ বসাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। যেসব জেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস নেই, সেসব জেলায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও থানা বা উপজেলা পর্যায়ের অনুমোদিত বিভিন্ন পশুর হাটে সোনালী ব্যাংকের চেস্ট শাখা দায়িত্ব বণ্টন করে দেবে।
Leave a Reply