গণপূর্ত অধিদপ্তরে একচ্ছত্র রাজত্ব ছিল জিকে বিল্ডার্সের মালিক এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীমের। নিজের প্রয়োজনে গড়ে তোলেন সমান্তরাল প্রশাসন। ফলে তার ইশারায় চলত পুরো অধিদপ্তর। বড় বড় সব প্রকল্পই বাগিয়ে নিতেন নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে। ছোট কাজেও ভাগ বসাতেন, কমিশনের বিনিময়ে বণ্টন করতেন পছন্দের ঠিকাদারদের মাঝে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ক্যাসিনোকা-ে গ্রেপ্তারের পর থেকে হারাতে থাকেন একের পর এক নিজের রাজত্ব ও ক্ষমতা। তার প্রতিষ্ঠানের নামে চলমান ১৭টি প্রকল্পের কার্যাদেশও বাতিল করে দিয়েছে সরকার। এর মধ্য দিয়েই গণপূর্ত বিভাগে কার্যত জিকে শামীম অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়।
গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর আলোচিত ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় বিপুল অঙ্কের টাকা, মাদক, অস্ত্র ও সাতজন দেহরক্ষীসহ গ্রেপ্তার হন গণপূর্তের যুবরাজ হিসেবে খ্যাত সাবেক যুবলীগ নেতা শামীম। র্যাব সে সময় বলেছিল, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির অভিযোগে জিকে শামীমকে আটক করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে বিদেশে অর্থপাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। অভিযানকালে শামীমের বাড়ি ও অফিস থেকে নগদ প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকা এবং ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর বা আমানতপত্র জব্দ করা হয়। এর পর চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি অনেকটা অগোচরেই মাদক মামলায় জামিন পান জিকে শামীম। ৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ থেকে অস্ত্র মামলায় ছয় মাসের জন্য অন্তবর্তীকালীন জামিন পান। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তুমুল বিতর্ক চলায় রাষ্ট্রপক্ষ তার জামিন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন জানান। পরবর্তীতে হাইকোর্ট তার জামিন বাতিল করেন। এর পরই জিকে শামীমের প্রতিষ্ঠানের নামে চলা বড় প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে
বিপাকে পড়ে কর্তৃপক্ষ। অবশেষে জিকে বিল্ডার্সের একক ও যৌথ নামে থাকা ১৭টি উন্নয়ন প্রকল্প বাতিল করে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ শুরু করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এমনকি নানা বিতর্কে জড়িয়ে থাকা শামীমের অনুসারীরা তাদের অবস্থান ধরে রাখতে বিভিন্ন মহলের দারস্থ হয়েও ব্যর্থ হয়েছেন।
বাতিল হওয়া প্রকল্পগুলো হলো- ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় নির্মাণ প্রকল্প, সচিবালয়ে ২০ তলা ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম হিলট্র্যাক কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের বাসভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম হিলট্র্যাক স্যুইট ও ডরমেটরি নির্মাণ, চট্টগ্রাম হিলট্র্যাক প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম হিলট্র্যাকের বিভিন্ন উন্নয়ন ও স্টিল ব্রিজ নির্মাণ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল নির্মাণ, আজিমপুর ২০ তলা ভবন নির্মাণ, শেরে বাংলানগরে নিটোর নির্মাণ, আশকোনা র্যাব সদর দপ্তর কমপ্লেক্স নির্মাণ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসাইন্স প্রকল্প, আগারগাঁও জাতীয় রাজস্ব ভবন নির্মাণ, এনজিও ফাউন্ডেশন ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম হিলট্র্যাক প্লাজা ও এমপি থিয়েটার এবং মহাখালী এস্তেমা সেন্টার নির্মাণ।
গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জিকে শামীমের পক্ষ থেকে কাজের সর্বশেষ অবস্থা নিরূপণ করতে প্রতিনিধির মাধ্যমে কাজের মূল্যায়ন শেষে আর্থিক দিক ঠিক হয়েছে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ) অনুযায়ী, টানা ২৮ দিন কাজ বন্ধ থাকার পর তারা আইনানুযায়ী কাজগুলো বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। সে নিয়মেই এসব কাজ বাতিল হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জিকে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও তার বাসাবোর বাসার ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে তা বাতিল কার্যকর করা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ‘পারফরম্যান্স গ্যারান্টি’ এবং ‘মৌলিক চুক্তি’ ভঙ্গ হয়েছে। চুক্তিপত্রের সাধারণ শর্তাবলী (জিসিসি) অংশের শর্ত ৪৪.২ অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করা, আবার সময় বাড়ানোরও কোনো আবেদন করা হয়নি। কাজের সর্বশেষ অবস্থা অনুযায়ী জিসিসি অংশের ১৭.১, ৪২.১, ৪৩.১ শর্ত সুনির্দিষ্টভাবে ভঙ্গ হয়েছে। এমনকি চুক্তিপত্রের সব আইনগত বৈধতাও হারিয়েছে। তাই পিপিআর-২০০৮-এর ৩৮(৫)-এর বিধিমতে চুক্তি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজের জন্য চুক্তিটির সব কার্যকারিতা বাতিল করা হলো। বাতিল-উত্তর সুবিধাজনক সময়ে জিসিসি অংশের ৭১.১ অনুযায়ী ‘লিক্যুইডিটেড ড্যামেজ’ বিষয়ে পিপিআরের আলোকে সম্পাদিত কাজের পরিমাপ ও পাওনা পরিশোধে (যদি থাকে) বিধিমতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে জিকে শামীমের বাতিল হওয়া ১৭টি প্রকল্পের কাজের মধ্যে চারটির নতুন টেন্ডার করা হয়েছে। এ বিষয়ে নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শওকত উল্লাহ বলেন, ‘জিকে শামীমের হিলট্র্যাকের কাজ বাতিল করে আমরা পুনরায় টেন্ডার করছি।’ গণপূর্ত আজিমপুর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস আহমেদ বলেন, ‘রাজধানীর আজিমপুরে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য তৈরি করা দুটি ২০ তলা ভবনের কাজটিও জিকে শামীমের কোম্পানির নামে ছিল। এ প্রকল্পে ১৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮৭৫ বর্গফুটের মোট ১৫২টি ফ্ল্যাট হবে এ দুটি ভবনে। কাজটি বাতিল করে নতুন টেন্ডার করা হয়েছে গত সপ্তাহে। এতে কাজটি পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস।’
বিষয়টি নিয়ে গত সোমবার জিকে শামীমের পক্ষে উচ্চ আদালতের দারস্থ হলে আদালত সরকারের পক্ষেই আদেশ দেন। অর্থাৎ তার পক্ষে করা রিট খারিজ করে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা জিকে শামীমের কোম্পানির নামে থাকা ১৭টি প্রকল্পের কাজ বাতিল করেছি। ইতোমধ্যে চারটি প্রকল্পের টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। বাকি কাজগুলোর টেন্ডারও প্রক্রিয়াধীন।’ তিনি বলেন, ‘গণপূর্তে শতভাগ ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্টের (ই-জিপি) মাধ্যমে দরপত্র করা হচ্ছে। এখানে কোনো সিন্ডিকেট থাকতে দেওয়া হবে না।’
এদিকে জিকে শামীম তার অস্ত্রধারী সাত দেহরক্ষীকে দিয়ে মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে টেন্ডারবাজি, বাস টার্মিনাল ও গরুর হাটে চাঁদাবাজি করে বিপুল সম্পদ অর্জন করেন। মানিলন্ডারিং মামলায় আদালতে দেওয়া সিআইডির অভিযোগপত্রে এমনটাই বলা হয়। সিআইডি আরও উল্লেখ করেছে, বিভিন্ন ব্যাংকে জিকে শামীমের ১৮০টি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩৩৭ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া ঢাকায় তার দুটি বাড়িসহ প্রায় ৫২ কাঠা জমি রয়েছে। এসব জমির দাম ৪১ কোটি টাকা। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, জিকে শামীম ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের ১৮০টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৬ হাজার ৫৮ কোটি ৪৯ লাখ ৫১ হাজার ৮৪২ টাকা লেনদেন করেন। এর মধ্যে সর্বাধিক লেনদেন হয় ২০১৮ ও ২০১৯ সালে।
শামীমের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে অভিযোগপত্রে এও বলা হয়, তার ব্যাংক লেনদেনে সর্বমোট ক্রেডিট হয়েছে ৩ হাজার ৪২ কোটি ৮৩ লাখ ৪৮ হাজার ৯১ টাকা। আর ডেবিট হয়েছে ৩ হাজার ১৫ কোটি ৬৬ লাখ তিন হাজার ৭৫১ টাকা। শামীম তার চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির টাকা বিদেশে পাচারের পরিকল্পনা করেছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয় মামলার চার্জশিটে।
Leave a Reply