ক্যালিফোর্নিয়ার সেনেটর কমালা হ্যারিসই হচ্ছেন ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের রানিং মেট – এটা ঘোষিত হবার পর তাকে নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে সারা বিশ্বেই।
নভেম্বরের নির্বাচনে যদি জো বাইডেন জয়ী হন – তাহলে কমালা হ্যারিসই হবেন প্রথম আমেরিকান নারী, কৃষ্ণাঙ্গ ও ভারতীয়-বংশোদ্ভূত ভাইস প্রেসিডেন্ট।
কমালা হ্যারিস নিজেই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবার চেষ্টা করেছিলেন। প্রথম দিকের বিতর্কগুলোয় ভালো করার পর তিনি সম্ভাব্য ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের প্রথম কাতারেও চলে এসেছিলেন।
তিনি সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন বিপক্ষের প্রতি কড়া কড়া প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবার জন্য। আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের টিভি বিতর্কে জো বাইডেনকেও তিনি প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে ছাড়েন নি।
তবে ২০১৯-এর শেষ দিকে এসে তার নমিনেশন পাবার যুদ্ধ মুখ থুবড়ে পড়ে, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে জো বাইডেনই এগিয়ে যান।
কিন্তু সেই বাইডেনেরই রানিংমেট হিসেবে আবির্ভূত হবার পর ৫৫ বছর বয়স্ক এই সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল এখন আবার ফিরে এসেছেন মনোযোগের কেন্দ্রে।
অভিবাসী পরিবারে জন্ম, ‘গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ’ হিসেবে বেড়ে ওঠা কমালা হ্যারিসের জন্ম ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ওকল্যান্ডে।
তার পিতা ডোনাল্ড জে হ্যারিস একজন জ্যামাইকান-বংশোদ্ভূত আমেরিকান এবং তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক। আর মা ভারতীয়-বংশোদ্ভূত শ্যামলা গোপালন একজন ক্যান্সার গবেষক এবং নাগরিক অধিকার কর্মী ।
কমালার মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি এবং তার বোন মায়াকে লালন পালন করেন প্রধানত শ্যামলা গোপালন একাই।
কমালা ভারতীয় হিন্দু ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত হয়েই বড় হন, মায়ের সাথে ভারতে বেড়াতেও গিয়েছেন তিনি।
তবে কমালা হ্যারিস বলেন, তার মা ওকল্যান্ডের কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছিলেন এবং তার মধ্যেই তার দুই মেয়েকে বেড়ে উঠতে দিয়েছেন।
কমালা হ্যারিস তার আত্মজীবনী ‘দ্য ট্রুথস উই হোল্ড’-এ লিখেছেন, “আমার মা খুব ভালো করেই বুঝেছিলেন যে তিনি দুটি কৃষ্ণাঙ্গ কন্যাসন্তানকে বড় করছেন।”
“তিনি জানতেন, যে দেশকে তিনি স্বদেশ হিসেবে বেছে নিয়েছেন সেখানে মায়া এবং আমাকে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে হিসেবেই দেখা হবে – আর তাই আমরা যেন আত্মবিশ্বাসী ও গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে বেড়ে উঠি তা তিনি দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত কতে চেয়েছিলেন।”
মিজ গোপালন কিছুকাল কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছিলেন – সেকারণে কমালা ও মায়া পাঁচ বছর মন্ট্রিয়েলেও ছিলেন, এবং সেখানকার স্কুলে পড়েছেন।
কমালা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রে ঐতিহাসিকভাবেই কৃষ্ণাঙ্গদের প্রধান কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম ছিল।
তিনি বলেন, তিনি সবসময়ই তার পরিচয় নিয়ে দ্বিধাহীন ছিলেন এবং নিজেকে ‘একজন আমেরিকান’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
আইন পেশা থেকে রাজনীতিতে
কমালা হ্যারিস আইনের ডিগ্রি নেন হেস্টিংসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে, এবং কাজ শুরু করেন আইনজীবী হিসেবে।
পরে তিনি প্রথম নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার এ্যাটর্নি জেনারেল হন এবং দু’বছর দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ২০১৪ সালে বিয়ে করেন আইনজীবী ডগলাস এমহফকে – এবং এখন তিনি দুটি সন্তানের বিমাতা।
এরই মধ্যে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একজন উদীয়মান তারকা হিসেবে কমালা হ্যারিসের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ২০১৭ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার জুনিয়র সেনেটর নির্বাচিত হন।
‘প্রগতিশীল’ ডেমোক্র্যাট?
তিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন কড়া সমালোচক। তা ছাড়া সেনেটের বিভিন্ন শুনানীতে আগতদের কড়া প্রশ্ন করার জন্যও তিনি বিখ্যাত হন।
কমালা হ্যারিস এ্যাটর্নি জেনারেল থাকার সময় সমকামীদের বিয়ে এবং মৃত্যুদন্ডের মতো বিষয়ে বামঘেঁষা অবস্থান নিলেও প্রগতিশীলরা কখনো কখনো তাকে ‘যথেষ্ট প্রগতিশীল না হবার জন্য’ তার সমালোচনা করেছেন।
তাদের অভিযোগ, পুলিশ সংস্কার বা দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে বিচারিক ভুলের মতো বিষয়ে গা-বাঁচানো অবস্থান নিয়েছেন হ্যারিস।
কমালা হ্যারিস প্রায়ই বলেন যে তার আত্মপরিচয়ই তাকে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার উপযুক্ত করে তুলেছে।
হয়তো জো বাইডেনের রানিং-মেট হবার কারণে এখন তার হোয়াইট হাউসের ভেতর থেকেই এটা করার সুযোগ মিলে যেতে পারে।
হ্যারিস মনে করেন , নারীরা যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবার যোগ্য – এটা স্পষ্ট করার জন্য এখনো অনেক কাজ করতে হবে।
তাকে রানিং মেট করায় জো বাইডেনের কতটা সুবিধা হবে?
কমালা হ্যারিসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ ও এশিয়ান বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতি আকৃষ্ট হবেন – এটাই অনেকে মনে করছেন।
তাছাড়া তার কড়া ভাষার সমালোচনা এবং প্রশ্ন করার ক্ষমতা হয়তো প্রচারাভিযানে ট্রাম্পের বিপক্ষে কাজে লাগতে পারে।
তবে অনেকে মনে করেন, ক্যালিফোর্নিয়ায় এটর্নি হিসেবে কমালা হ্যারিস অনেক সময় পুলিশের পক্ষ নিয়েছেন, যা জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনার পর ভিন্ন চোখে দেখা হতে পারে।
অন্যদিকে প্রচারাভিযানের সময় তার কিছু বামঘেঁষা কথা মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাটদের অস্বস্তিতে ফেলতে পারে।
‘প্রেসিডেন্টের সুযোগ্য ডেপুটি’ মাইক পেন্স ট্রাম্পের রানিং মেট
এবছর মার্কিন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লড়ছেন দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য, আর তার রানিং মেট হচ্ছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স।
বলা হয়, গত চার বছরে হোয়াইট হাউসে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন মাইক পেন্স।
তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন প্রেসিডেন্টের একজন সুযোগ্য ডেপুটি হিসেবে – যিনি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগগুলো কারা পাবেন তা ঠিক করার দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তা ছাড়া মিডিয়ার সাথে কথা বলার ক্ষেত্রেও দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি।
তবে একসময় তিনি ট্রাম্পের নীতির সমালোচনা করতেও পিছপা হননি।
মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাবকে তিনি ‘অবমাননাকর এবং অসাংবিধানিক’ বলেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছিল কিনা তা নিয়ে ট্রাম্প যখন সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন তারও বিরোধিতা করেন তিনি। অবশ্য এখন তাকে প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করতে খুব কমই শোনা যায়।
তবে ইন্ডিয়ানা রাজ্যের গভর্নর থাকার সময় ব্যক্তিগত ইমেইল এ্যাকাউন্ট ব্যবহারের কারণে তার সমালোচনা হয়েছিল, কারণ এই ইমেইল ব্যবহারকে কেন্দ্র করেই তিনি নিজে এক সময় হিলারি ক্লিনটনের ব্যাপক সমালোচনা করেছিলেন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে মন্তব্যের কারণেও তিনি একবার সমালোচিত হয়েছিলেন।
উদারনৈতিক সূচনা
মাইক পেন্সের জন্ম ইন্ডিয়ানা রাজ্যের কলম্বাস শহরে এক ক্যাথলিক খ্রিস্টান পরিবারে। তারা ছিলেন ছয় ভাইবোন।
পেন্স ২০১২ সালে ইন্ডিয়ানাপলিস স্টার নামে এক পত্রিকায় সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছিলেন, জন এফ কেনেডি এবং মার্টিন লুথার কিংএর মতো উদারনৈতিক নেতাদের জন্যই তিনি রাজনীতিতে আসতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
২০১৩ থেকে চার বছরের জন্য ইন্ডিয়ানার গভর্নর ছিলেন মাইক পেন্স। সে সময় তিনি নিজেকে বর্ণনা করেছিলেন ‘যথাক্রমে একজন খ্রিস্টান, একজন রক্ষণশীল এবং একজন রিপাবলিকান’ বলে।
কিন্তু ১৯৮০র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দিনি ভোট দিয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জিমি কার্টারকে।
কলেজে পড়ার সময় এক ইভাঞ্জেলিকাল গির্জায় তার পরিচয় হয় তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী কারেনের সাথে, এবং তখন থেকেই তার চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে।
আইনসভার সদস্য হিসেবে পেন্সের ১২ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্য ছিলেন।
এছাড়া তিনি হাউস রিপাবলিকান কনফারেন্সেরও সভাপতি ছিলেন – যা পার্টির নেতৃত্বের পদগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
পেন্স নিজেও ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিন্তা করেছিলেন। তা শেষ পর্যন্ত না হলেও ২০১৬ সালে ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের সময় তিনি ছিলেন অত্যন্ত ব্যস্ত।
খ্রিস্টান, রক্ষণশীল এবং একজন রিপাবলিকান
ইন্ডিয়ানার গভর্নর থাকার সময় ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনস্থাপন অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করার পর রাজ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল।
সমালোচকদের যুক্তি ছিল, এটি এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক। জনমতের চাপে পেন্স পরে একটি সংশোধনী আনেন – যা আবার রক্ষণশীলদের সমালোচনার শিকার হয়।
মাইক পেন্স – যিনি তিন সন্তানের পিতা – গর্ভপাতের একজন কড়া বিরোধী হিসেবে পরিচিত। ইন্ডিয়ানায় তিনি যে গর্ভপাতবিরোধী আইন করেছিলেন তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম কঠোর আইন।
২০১৭ সালে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় একটি গর্ভপাত-বিরোধী সমাবেশে যোগ দেন – যা আগে কখনো হয়নি।
পেন্স ২০১২ সালে যখন কংগ্রেস সদস্য – তখন সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্ট ওবামার স্বাস্থ্য সেবা আইনের পক্ষে এক রুলিং দেয়। রিপাবলিকান সদস্যদের একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে একে ৯/১১ সন্ত্রাসী আক্রমণের সাথে তুলনা করেছিলেন তিনি। বিবিসি
Leave a Reply