নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণকা-ের কারণ হিসেবে স্থানীয়রা যে আশঙ্কা করছিলেন, অবশেষে তা-ই সত্যি হতে যাচ্ছে। মসজিদের পাশ দিয়ে টানা তিতাসের গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে বের হওয়া পুঞ্জীভূত গ্যাসের জন্যই বিস্ফোরণ হয়েছেÑ প্রাথমিকভাবে এমনটিই বলছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। গতকাল সোমবার গ্যাসলাইনের লিকেজ খুঁজতে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করে মসজিদের উত্তর পাশের পাইপে দুটি লিকেজ পাওয়া গেছে।
এদিকে গত শুক্রবার রাতে ভয়াবহ সেই বিস্ফোরণে দগ্ধ ৩৭ মুসল্লির মধ্যে গতকাল রাত পর্যন্ত ২৭ জনই মারা গেছেন। অবশিষ্ট ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। আর দগ্ধ মো. মামুনকে (৩০) চিকিৎসা শেষে শঙ্কামুক্ত জানিয়ে গতকাল হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে ভয়ঙ্কর এ বিস্ফোরণে নামাজরত অবস্থায় দগ্ধ হন অর্ধশতাধিক মুসল্লি। তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ৩৭ জনকে রাজধানীর
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে গতকাল সোমবার বিকাল পর্যন্ত চিকিৎসাধীন মারা গেছেন ইমাম ও মুয়াজ্জিনসহ ২৭ জন।
অন্যদিকে মসজিদে বিস্ফোরণে হতাহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে গতকাল দুপুরে বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে মানববন্ধন করেছেন চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকা-ে নিহতদের স্বজনরা। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী স্বাধীন বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনায় একটা তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন থেকে যায় আমাদের আড়ালে, আমরা কিছুই জানতে পারি না। নারায়ণগঞ্জ বিস্ফোরণের ঘটনায় তদন্ত যেন কোনোভাবেই কারও দ্বারা প্রভাবিত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, মসজিদে বিস্ফোরণে দগ্ধ ৩৭ জনকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এদের মধ্যে সোমবার বিকাল পর্যন্ত ২৭ জন মারা গেছেন। আর এই প্রথম মামুন নামে এক রোগীকে ছাড়া হলো। বাকি ৯ জন এখনো আইসিইউ ও পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিস্ফোরণে মামুনের শরীরের ১৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। তবে তার শ্বাসনালি দগ্ধ হয়নি। ঘা শুকাতে সময় লাগবে। তাকে দুই সপ্তাহ পর ফলোআপের জন্য আসতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো সমস্যা দেখা দিলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মামুন বলেন, বড় ভয়ঙ্কর ছিল সেই রাত। মসজিদের ভেতরে বিকট শব্দে হঠাৎ বিস্ফোরণের পর চারদিকে দেখি আগুনের লেলিহান শিখা। গায়ে জড়ানো আগুন নিয়ে ছোটাছুটি করছেন মুসল্লিরা। ঘটনার সময় আমি মসজিদের গেটের বাইরে ছিলাম। বিস্ফোরণের পর কখন যে আমার শরীরেও আগুন লেগে গেল বুঝতে পারিনি। দৌড়ে কোনোরকমে মসজিদের সামনের রাস্তায় জমে থাকা পচা পানিতে গড়াগড়ি দিই। এরপর দগ্ধ অন্যরা একে একে বেরিয়ে এসে সেই পানিতেই ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকেন। সবার শরীর পুড়ে কালো হয়ে গেছে; পরনে কাপড় নেই; সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন সবাই। লোকজন ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর আর কিছ– মনে নেই আমার। কখনো ভাবতে পারিনি বেঁচে ফিরব। বাসায় যেতে পারব। যেখানে চোখের সামনেই একসঙ্গে পোড়া মানুষগুলো ছেড়ে যাচ্ছিলেন পৃথিবী।
মামুন বলেন, শুনেছি ২৭ জন মারা গেছেন। কিন্তু আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন; তার জন্য শুকরিয়া। সুস্থ হয়ে বাসায় যেতে পারছি, খুব ভালো লাগছে। আমার জন্য দোয়া করবেন সবাই।
মাটি খুঁড়ে মিলল গ্যাস পাইপের দুই লিকেজ
নারায়ণগঞ্জে মসজিদে ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্যাসলাইনের লিকেজ খুঁজতে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে মসজিদের উত্তর পাশের পাইপে দুটি লিকেজ পাওয়া গেছে। সোমবার সকাল থেকে মসজিদের সম্মুখে, উত্তর ও পূর্ব পাশে চারটি স্থানে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। বেলা সোয়া ৩টায় খোঁড়াখুঁড়ির একপর্যায়ে মসজিদের উত্তর পাশে খোঁড়াখুঁড়িতে কর্মরত শ্রমিকরা মাটির তিন স্তরের নিচে ৪ ফুট গভীরে পৌনে ১ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপে দুটি সংযোগ লাইনে দুটি লিকেজের অস্তিত্ব খুঁজে পান। দুটি পাইপের ছিদ্রগুলো আকারে বড়। শ্রমিকরা বলছেন এটি দিয়ে অনেক প্রেসারে গ্যাস বের হয়।
তবে এ লিকেজ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা তিতাসের স্থানীয় অফিসের ডিজিএম মফিজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, খোঁড়াখুঁড়ি শেষ হোক। তারপর বিস্তারিত বলা যাবে। তিতাসের রেডিও ডিরেক্টর রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে গ্যাস পাইপ লিকেজ রয়েছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য শ্রমিকরা সকাল ৭টা থেকে কাজ শুরু করেন। লিকেজ ধরা পড়া অংশটি মসজিদের উত্তর পাশের মসজিদ ঘেঁষা রাস্তার অংশ।
লিকেজ দুটি পাওয়ার পর তিতাস কর্তৃপক্ষ একে অপরকে বলেন, তিতাসের নকশা অবস্থানের সঙ্গে এ লাইন দুটি মিলছে না। এটি পৌনে ১ ইঞ্চি ব্যাসের শাখা লাইন। এরপর তারা মূল সংযোগ লাইন খোঁজা শুরু করেন। কিন্তু গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত মূল সংযোগ লাইন তারা খুঁজে পাননি।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার আবদুল ওয়াহাব তালুকদার বলেন, সরেজমিন আমরা দেখতে চাই মসজিদের নিচে গ্যাসের লাইন আছে কিনা। যদি থেকে থাকে তা হলে মসজিদ তার কতটুকু দূরে। সেখান থেকে গ্যাস বের হয়েছে কিনা। মসজিদ তৈরির সময় আমাদের লাইনটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তৈরি করা হয়েছে কিনা। এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের যে লাইনে গ্যাস আছে সে লাইনের কন্ডিশন কতটুকু ভালো বা খারাপ, সেটাও দেখার বিষয় আছে। ওই লাইনটা বেশ পুরনো লাইন, অন্তত ৩০ বছর পুরনো। যেখান থেকে গ্যাস বের হচ্ছে সেই লাইনের ব্যতিরেকে অন্য জায়গায় যদি লাইন ভালো থাকে, তা হলে আমরা সবাই বুঝতে পারব মসজিদ তৈরির সময় ফাউন্ডেশন করতে গিয়ে আমাদের পাইপ লাইন ড্যামেজ করে মসজিদ তৈরি করেছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের জানিয়েছে কিনা। আর ড্যামেজটা কীভাবে হয়েছে তা চিহ্নিত করার জন্যই আজ আমরা মাটি কেটে সেটা সরেজমিন দেখতে চাচ্ছি।
তিতাসের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নকশা অনুযায়ী গ্যাসলাইন আছে কিনা আমরা তা দেখছি। এখানে আশপাশে যে গ্যাসলাইনগুলো দেওয়া হয়েছে তা ১৫-২০ বছর আগে দেওয়া হয়েছে। মসজিদের উত্তর পাশে আমরা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করব, ফাইলগুলো আমরা দেখব। কানেকশনগুলো কীভাবে হয়েছে, তাও দেখব। আমরা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি মসজিদটি ইউনিয়ন পরিষদের জায়গায় এবং সড়কটি সিটি করপোরেশনের জায়গায়। এখানে সীমানায় সমস্যা আছে। আগে আমাদের লাইন হয়েছে, পরে মসজিদ। সবাই জানেন, মসজিদের পেছনের অংশ প্রথমে হয়েছে এবং সামনের অংশ পরে। আমরা যে মাটিটা কেটেছি, তার দুটি লেয়ার বের করেছি। এখন আমরা এন্টিলেয়ার পেয়েছি। তারপর আরেকটা এন্টিলেয়ার আমরা পেয়েছি। সে ক্ষেত্রে আমরা পুরোটা খুঁড়ে দেখি তারপর নির্দিষ্ট করতে পারব।
তিনি আরও বলেন, নকশার ওপরে মসজিদ বা স্থাপনা হলে তার দায়িত্ব তিতাস নেবে। তিতাসের ডিস্ট্রিবিউশন অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে স্থানীয়রা তিতাসকে এ বিষয়ে ইনফর্ম করে। এই ধরনের কোনো ইনফরমেশন আমাদের তিতাস অফিসে নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিতাসের জেনারেল ম্যানেজার বলেন, গত শনিবার মসজিদ কমিটির সভাপতির সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর আমরা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ ঘটনার তারা লিখিত কোনো অভিযোগ করেছিলেন কিনা। তারা তা করেননি। তিনি নিজে গিয়ে তিতাসকে জানিয়েছে কিনা। তিনি বলেন, আমি জানাইনি। সাধারণ সম্পাদকের কাছে শুনেছি, উনি নাকি টেলিফোনে ইনফর্ম করেছেন। এখন সাধারণ সম্পাদক কোথায়? তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। এখন সাধারণ সম্পাদক যদি কোনো নাম্বার বা তিতাসের লোকের সন্ধান দেন বা মসজিদ কমিটি কোনো ইনফরমেশন দেন তাহলে আমরা চিহ্নিত করতে সক্ষম হব। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাচ্ছি, মসজিদ কমিটি লিকেজ সারানোর জন্য কাকে বলেছে। আমাকে ওই ব্যক্তির নাম দিন আমরা চরম প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেব।
গণশুনানিতে ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ
মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গণশুনানিতে ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। সোমবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববির অফিস কক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। সকাল ১০টা থেকে গণশুনানির সময় দেওয়া হলেও দুপুর ৩টা পর্যন্ত কেউই আসেননি। ৩টার পর একদল লোক আসেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। পরে তারা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে সাক্ষ্য দেন। পরে সাক্ষীদের লিখিত সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা সবাই বাইতুস সালাত মসজিদ কমিটির সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য আবদুল গফুরের অনুসারী।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে বিএনপির প্রতিনিধি দল
বিকাল ৪টায় বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জে মসজিদের বিস্ফোরণস্থলে পৌঁছায়। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে শাহজাহান বলেন, আমরা দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে এসেছি। আমরা উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার প্রকৃত কারণ বের করার দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।
এর আগে দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে রওনা দেয় বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। তাদের মধ্যে আর রয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হারুনুর রশিদ এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, সহসাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ ও শহীদুল ইসলাম বাবুল। সোমবার এই প্রতিনিধি দল ক্ষতিগ্রস্ত ৩৭টি পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে নারী ও শিশু অধিকার ফোরাম মঙ্গলবার (আজ) ক্ষতিগ্রস্ত ২০টি পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করবে বলে গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের সময়কে জানান সংগঠনের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী।
স্বজনদের আর্তনাদ থামছে না
একদিন আগে ছেলের লাশ দাফন হয়েছে। পরদিন ছেলের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন বাবাও। বাইতুস সালাত মসজিদে বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শিশু জুবায়ের মৃত্যুর পর বাবা জুলহাসও মারা যান। পটুয়াখালীর রাঙাবালী উপজেলার বাহেরচর গ্রামের এক পরিবারের এই দুই সদস্যকে হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন স্বজনরা। তাদের আর্তনাদ যেন থামছেই না।
শোকার্ত এ পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে গত রবিবার রাতে নিহতদের বাড়িতে ছুটে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান। সেখানে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। পরিবারকে সান্ত¡না দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওই পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন এবং তাৎক্ষণিক ব্যক্তিগতভাবে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন ইউএনও। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমরা এই অসহায় পরিবারের পাশে আছি।’
এদিকে রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় উপজেলা সদরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে জুলহাসের ছেলে ৭ বছরের শিশু জুবায়েরের নামাজে জানাজা শেষে ওই ঈদগাহসংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়। গতকাল সোমবার ৯টায় একই স্থানে জুলহাসের জানাজা শেষে ছেলের পাশেই দাফন করা হয় তাকেও।
অগ্নিকা-ের পর জুলহাস ও তার ছেলে জুবায়ের আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইউনিটে নেওয়া হলে শুক্রবার রাত ১টায় ৭ বছরের শিশু জুবায়ের মারা যায়। গ্রামের বাড়িতে ছেলের লাশ নিয়ে আসার পর রবিবার সকাল ৮টায় দাফন-কাফনের প্রস্তুতিকালে খবর আসে জুলহাসও মারা গেছে।
স্থানীয়রা জানায়, ছোটবেলায় জুলহাসের বাবা বাচ্চু ফরাজী মারা যান। তখন জুলহাসের বয়স ১০-১২ বছর। অভাব-অনটনের সংসারের হাল জুলহাসকেই ধরতে হয়। কিন্তু বিয়ে করার পর সেই সংকট আরও বেড়ে যায়। তাই ১০ বছর আগে স্ত্রীসহ ঢাকায় পাড়ি জমান। সেখানে গার্মেন্ট শ্রমিকের কাজ করতেন জুলহাস। নিহত জুলহাসের স্ত্রী রাহিমা বেগম বলেন, ‘জুলহাস নিয়মিত নামাজ পড়ত। প্রায়ই ছেলেকে নিয়ে নামাজে যেত সে। কিন্তু ওইদিন ছেলে যেতে চায়নি। সে টিভি দেখতে চেয়েছিল। তবুও ছেলেকে বাবার সঙ্গে নামাজে পাঠান তিনি।’ এখন বেঁচে থাকার সম্বল আদরের একমাত্র ছেলে ও স্বামীকে হারিয়ে নির্বাক রাহিমা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান বলেন, ‘জুলহাস ও জুবায়েরের পরিবারকে আমি ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। নিহত অপর দুজনের পরিবারকেও সহায়তা দেওয়া হবে। নিহত চারজনের তথ্যই সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মহোদয় প্রত্যেক পরিবারকে এক একর করে জমি দেবেন বলে জানিয়েছেন। ওইসব পরিবারকে শুকনো খাবার বিতরণের প্রক্রিয়াও চলছে।’
মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস একটি, তিতাস গ্যাস ও ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ দুটি ও জেলা প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রাথমিক তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন জানিয়েছেন, এসি নয় মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে মসজিদের পাশ দিয়ে টানা গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে বের হওয়া পুঞ্জীভূত গ্যাস থেকে।
পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে এসে লাশ হয়ে ফিরলেন নয়ন
মায়াবী হাস্যোজ্জ্বল টগবগে তরুণ শুকুর আলী নয়ন। ছোটবেলা থেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। হৃদয়ে ছিল অনেক স্বপ্ন। মা-বাবা আর ছোট ভাইদের মুখে হাসি ফোটাতে চাকরির জন্য গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ শহরে। কিন্তু সেই স্বপ্ন নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। সেদিন মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে নিজের নামটা লিখিয়ে নিলেন লাশের সারিতে।
শুকুর আলী নয়ন (২৫) লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মেহের আলী ও বুলবুলি বেগমের ছেলে। রবিবার বিকালে উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের তালুক পলাশী গ্রামে তার লাশ দাফন করা হয়। নয়ন নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় এক বছর ধরে চাকরি করছিলেন। পারিবারিক সূত্র জানায়, শুক্রবার রাতে মসজিদে ওই ভয়াবহ বিস্ফোরণে শুকুর আলী নয়ন দগ্ধ হন। ছেলের বন্ধুর কাছ থেকে মুঠোফোনে সেই খবর পেয়ে রাতেই মা বুলবুলি বেগম আদিতমারী থেকে ঢাকার পথে রওনা হন। শনিবার সকাল ৬টার দিকে ঢাকায় পৌঁছান। ছুটে যান ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। সেখানেই অপেক্ষা করতে থাকেন। বিকালে ছেলের মৃত্যু খবর পান বুলবুলি বেগম। রাতে ছেলের লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি।
নয়নের বন্ধু শামীম বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের গার্মেন্ট কারখানা ছুটি হয়। নয়ন বাসায় ফিরে নামাজ পড়তে এসেছিল। নামাজ পড়ে গিয়ে আমাদের একসঙ্গে খাবার খাওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ খবর পেলাম বিস্ফোরণ, আগুন লেগেছে। গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। আমরা ওই মসজিদের মেসেই থাকি। তাকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ওর লাশ ও মোবাইলটি পাই। এরপর ওর বাড়িতে কথা হয়। ওর ভগ্নিপতি ও মা শনিবার সকাল ৬টায় ঢাকায় পৌঁছালে লাশ বুঝে পান। এরপর আমরা ১৫ হাজার টাকায় একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে লাশ নিয়ে রওনা দিই।
নয়নের মা বুলবুলি বেগম বিলাপ করে বলেন, তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিল বড় ছেলে নয়ন। সেও আল্লাহর ডাকে চলে গেল।
যারা মারা গেছেন
বাইতুস সালাত জামে মসজিদে দুর্ঘটনায় মৃত ২৭ জন হলেনÑ মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক (৬০), মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন (৪৮), জুবায়েদ ফারাজি (৬), মো. নিজাম (৪০), রিফাত (১৮), মোস্তফা কামাল (৩৪), জুবায়েদ (১৮), সাব্বির (২১), কুদ্দুস ব্যাপারী (৭২), হুমায়ুন কবির (৭০), ইব্রাহিম (৪৩), জুনায়েদ (১৭), জামাল (৪০), রাশেদ (৩০), জয়নাল (৩৮), মাইন উদ্দিন (১২), রাসেল (৩০), বাহাউদ্দিন (৬০), কাঞ্চন হাওলাদার (৪০), নয়ন (২৭), নাদিম আহমেদ (৪০), জুলহাস ফারাজি (৩৫), শামীম (৪৫), মোহাম্মদ আলী (৫৫), আবুল বাশার মোল্লা (৫০), মনির ফরাজি (৩০) ও ইমরান (৩০)।
Leave a Reply