খোন্দকার কাওছার হোসেন॥ শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে নানা বিতর্কের পর অবশেষে জানা গেল কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ নন। গতকাল শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে তার হাটু ও হাতের এক্সরে করার পর হাসপাতালটির পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল হারুন এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান।
খালেদা জিয়া অসুস্থ এ নিয়ে তার দল বিএনপি গত কয়েকদিন যাবত শোরগোল করছিল। বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত তার চিকিৎসার দাবি জানাতে থাকে। তারা খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের কারাগারে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার আহ্বান জানান। এমনকি দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপি চেয়ারপারসনকে জামিন দিয়ে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার আহ্বান জানান। সরকারের তরফ থেকেও জেলকোড অনুযায়ি ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে কারাবন্দি হওয়ার দুই মাস পর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গতকাল কারাগার থেকে খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নিয়ে আসে কারাকর্তৃপক্ষ। বেলা সোয়া ১১টার দিকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের পুরনো কারাগার থেকে কালো রঙের একটি গাড়িতে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সাড়ে ১১টার কিছু সময় পরই বিএসএমএমএইতে পৌঁছান খালেদা জিয়া। পুলিশের ওই গাড়ির সামনে পেছনে ছিল একটি অ্যাম্বুলেন্স এবং আরও দুটি গাড়ি। আগে-পিছে ছিল র্যাবের পাহারা। সাদার ওপর কালো প্রিন্টের সুতি শাড়ি পরা খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে হেঁটেই ওঠেন কেবিন ব্লকের লিফটে। ৫তলায় ৫১২ নম্বর কেবিন আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর জন্য। তবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারাগারে থাকা গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমকে এ সময় তার সঙ্গে দেখা যায়নি। খালেদা জিয়া কেবিনে যাওয়ার পর ডা. ওয়াহিদুর রহমান, এফ এম সিদ্দিকী ও মো. মামুনকে নিয়ে সেখানে যান বিএসএমএমইউর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল হারুন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য যে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে, এরা সেই বোর্ডের সদস্য নন। ডা. মামুন বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। বিএসএমএমইউর কর্মকর্তারা জানান, খালেদা জিয়ার এক্সরে ও রক্ত পরীক্ষা করা হয়। প্যাথলজি বিভাগ থেকেও হেঁটে হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে যান তিনি। দুই ঘণ্টা পর বেলা দেড়টার দিকে খালেদা জিয়াকে নিয়ে কারাগারের পথে রওনা হয় একই গাড়ি; আগের মতোই পাহারা নিয়ে। পৌনে ২টার দিকে নাজিমউদ্দিন সড়কের কারাগারে ঢোকে গাড়িবহর। এরপরই গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে হাসপাতালটির পরিচালক জানান, রেজিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে খালেদা জিয়ার হাড়ের বিভিন্ন অংশের এক্সরে করা হয়। এই এক্সরে করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিকেল বোর্ড উপদেশ দিয়েছিলেন। আশা করি এই এক্সরে রিপোর্টটি আগামীকালকেই আমরা পেয়ে যাবো। এরপর এটি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেবো। হাসপাতালের শহীদ মিলন মিলনায়তনে এই ব্রিফিংয়ে পরিচালক আরো জানান, উনি (খালেদা জিয়া) আসার আগে তার পছন্দ অনুযায়ী যেসব চিকিৎসকের উপস্থিতি চেয়েছিলেন তারা ছিলেন। তারা হলেন-ডা. মামুন (খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক), ডা. এফ এম সিদ্দিকী ও ডা. ওয়াহিদুর রহমান। কারাগারের একজন চিকিৎসক ডা. শুভও এ সময়ে ছিলেন। জানা গেছে, ডা. মামুন হৃদরোগ চিকিৎসক), ডা এফএম সিদ্দিকী মেডিসিন ও ডা. ওয়াহিদুর রহমান নিউরো মেডিসিনের চিকিৎসক। মোট চারজন চিকিৎসকের উপস্থিতি চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তার মধ্যে একজন হাসপাতালে গেটে এসেও প্রবেশ করতে পারেননি বলে জানা গেছে। তিনি হলেন, অ্যাপেলো হাসপাতালের কনসালটেন্ট এম আলী। ৭৩ বছর বয়সী খালেদা জিয়া কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ১ এপ্রিল কারা কর্তৃপক্ষের আবেদনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামসুজ্জামানকে প্রধান করে চার সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করে। তারা সেদিন দুপুরে পুরনো ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন, ঢাকা মেডিকেলের ডা. মনসুর হাবীব (নিউরোলজি), টিটু মিয়া (মেডিসিন) ও সোহেলী রহমান (ফিজিক্যাল মেডিসিন)। এই মেডিকেল বোর্ড গত সপ্তাহে কারাগারে বিএনপি চেয়ারপারসনকে দেখে এসে জানিয়েছিল, তার অসুস্থতা গুরুতর নয়। অথচ তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা আগেই জানিয়েছিলেন, খালেদা জিয়ার হৃদযন্ত্র, চোখ ও হাঁটুর সমস্যা রয়েছে। সেজন্য তাকে নিয়মিত নানা রকম ওষুধ খেতে হয়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হওয়ার পর খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা তাকে দেখতে চাইলেও কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি পায়নি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল হারুন বলেন, উনি (খালেদা জিয়া) কেবিন থেকে হেটে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে এসেছেন। আবার হেটে গাড়িতে উঠেছেন। আপাত দৃষ্টিতে দেখেছি উনি ভালো আছেন। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো সম্পন্ন হয়ে গেলে তার শারীরিক কোনো অসুবিধা আছে কিনা তা মেডিকেল বোর্ড বলতে পারবেন। তিনি জানান, আমরা উনার জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম এবং উনি আমাকে নিজেই বলেছেন আমি হেটে যেতে পারবো। আমার হুইল চেয়ার প্রয়োজন নেই। শাশুরীর খবর পেয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে হাসপতালে উপস্থিত হন খালেদা পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তারা গাড়ি থেকে নেমে কেবিন ব্লকে ঢুকতে চাইলে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। এরপর হাসপাতাল প্রাঙ্গণে গাড়ির ভেতরেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন তারা। তখন তাদের ঘিরে জটলা করেছিল জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের একদল নেতা-কর্মী। সেখানে সেøাগান দেয়ার সময় চার-পাঁচজনকে আটক করে পুলিশ। এরমধ্যেই হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে ঢোকেন কোকোর স্ত্রী-সন্তানরা। দেড়টার দিকে খালেদা জিয়া বের হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন তারা। বিএনপি তাদের নেত্রী খালেদার অসুস্থতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। তার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডকে লোক দেখানো বলেও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দলটির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। সরকারি চিকিৎসায় অনাস্থা জানিয়ে সুচিকিৎসার জন্য দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেছেন তিনি। বিএসএমএমইউতে বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলাকালে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমরা জানি না, কেন ওনাকে এখানে আনা হয়েছে। আমাদের কিছু জানানো হয়নি। আমরা এতদিন ধরে যা বলে আসছিলাম, এখন সরকারের মেডিকেল বোর্ড গঠন করার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে উনি অসুস্থ। তিনি বলেন, সরকারের চিকিৎসায় আমাদের একেবারেই বিশ্বাস নেই। তাকে একটি নির্জন, পরিত্যক্ত কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে। সেখানে এমনিতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আমরা চাই, তাকে মুক্তি দেয়া হোক। তাহলে তিনি নিজের চিকিৎসা নিজের ডাক্তারদের দিয়ে করিয়ে সুস্থ হবেন বলে আমরা মনে করি। গত শুক্রবার বিকালে কারাগারে খালেদা জিয়াকে দেখে এসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ম্যাডামের স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো নয়। তার আর্থরাইটিসের সমস্যা বেশ বেড়ে গেছে। তার হাঁটতেও কষ্ট হয়। যেটাকে কিছুটা স্নায়ুবিক সমস্যা বলা হয়, সেটাও দেখা দিয়েছে। সত্যিকার অর্থেই তিনি কিছুটা স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েছেন। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, যারা তার নিয়মিত চিকিৎসা করেন, তাদেরকে দিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হোক এবং যে চিকিৎসা দরকার, অবিলম্বে তা দেয়া হোক। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে হাসপাতেল নেয়াকে নাটক আখ্যায়িত করেছে বিএনপি বলেছে, চিকিৎসার নামে তাকে হেনস্তা করা হয়েছে। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, দেশনেত্রীর আজকে চিকিৎসার কিছুই হয়নি। শুধু হেনস্তা করা হল, হয়রানি করা হল। শুধু মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়ার জন্য সরকার এই নাটকটি করেছে, এই বায়স্কোপটি করেছে, এই প্রহসন করেছে। তার নেত্রীকে বাধ্য করে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে তাকে অনেকটা জোর করেই নিয়ে আনা হয়েছে। আমরা শুনেছি, কারাগারের তার কক্ষে গিয়ে বার বার তাগিদ দিয়েছে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে। রিজভী বলেন, আমাদের প্রিয়নেত্রীকে তো কখনও এই লেবাসে দেখিনি। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী হিসেবে ৩০/৩২ বছর ধরে তিনি শাড়ির ওপর চাদর অথবা ওড়না পরিধান করেন। আজকে সেটি পরিধান করারও সুযোগ দেয়া হয়নি। সুচিকিৎসার অভাবে দেশনেত্রীর কোনো ক্ষতি হলে এর দায় সরকারকেই নিতে হবে বলেও সরকারকে হুঁশিয়ার করেন রিজভী। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে গেছেন। আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তার চিকিৎসা সেবার সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছি। তিনি একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, একজন রাজনীতিবিদ, তিনি অবশ্যই সুচিকিৎসা সেবা পাবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চিকিৎসকদের পরামর্শে এবং জেল কোড অনুযায়ী হবে, এতে সরকার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না।
Leave a Reply