জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সফটওয়্যারের নিরাপত্তা ত্রুটির পুরো বিষয় নখদর্পণে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের। এমনকি তাদের কারসাজিতে এনআইডি সার্ভারে সংরক্ষিত কোনো ব্যক্তির আঙুলের ছাপও মেলে না। এভাবেই আগে এনআইডি থাকলেও নতুন করে আঙুলের ছাপ নিয়ে জাল এনআইডি তৈরি করছে। অপরাধমূলক কাজের জন্য এ ধরনের এনআইডি তৈরি হচ্ছে। মূলত স্থায়ী চাকরি না হওয়ায় আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত অনেক কর্মী ভয়ঙ্কর এ অপরাধে জড়িয়েছে। দুর্বল নজরদারির সুযোগ নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে বিভিন্ন অপরাধী চক্র আউটসোর্সিং কর্মীদের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে এনআইডি জালিয়াতির কাজ করছে।
ইসির আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত দুই কর্মীসহ একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর দুদিনের রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বিস্তারিত তথ্য পেতে গতকাল বুধবার আদালতের মাধ্যমে দুই ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর ও আনোয়ারুল ইসলামকে আবার দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার চক্রের সদস্যরা জানিয়েছে, মাঠ পর্যায়ের অনেক নির্বাচন কর্মকর্তা জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য আউটসোর্সিংয়ে নিয়োজিত ডেটা এন্ট্রি অপারেটরকে সফটওয়্যার ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে থাকেন। তাদের মাধ্যমে অপরাধীরা এনআইডি জালের সুযোগ নিয়ে থাকে। এ অপকর্মের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের ইসি কর্মকর্তারাও জড়িত থাকতে পারে। গ্রেপ্তার চক্রটি জাল এনআইডি দিয়ে ঋণখেলাপি ব্যক্তিরা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ নিতেন। ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনো ধরনের অনুসন্ধান ছাড়াই জাল এনআইডিধারীদের মোটা অঙ্কের ঋণ দিয়েছেন। এমনকি এক ব্যক্তি তিন কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন বলেও তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
ডিবির হাতে গ্রেপ্তার আবদুল্লাহ আল মামুন ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং সিটি ব্যাংক থেকে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন। তার স্ত্রী রোজিনা রহমানের নামে জাল এনআইডি তৈরি করে মোটা অঙ্কের ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনাও করে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা পুলিশ।
ডিবির কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা রিমান্ডে যেসব তথ্য দিয়েছে, এগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পাশাপাশি তারা অনেক তথ্য গোপন করেছে। গোপন করা তথ্য এবং এই সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রে আরও কারা রয়েছে তাদের চিহ্নিত করতে আরও ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা। অপরাধী চক্র জাল এনআইডি দিয়ে আরও কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিনা এ বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসি রাজীব আল মাসুদ আমাদের সময়কে বলেন, জাল এনআইডি তৈরির সঙ্গে যুক্ত দুই ডেটা এন্ট্রি অপারেটরকে আবার দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এ চক্রের সঙ্গে ইসি বা ব্যাংকের কেউ জড়িত রয়েছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ইসি বা ব্যাংকের কারও সম্পৃক্ততা আছে কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ডিবির লালবাগ বিভাগের সংঘবদ্ধ অপরাধ ও গাড়ি চুরি প্রতিরোধ টিমের সহকারী কমিশনার (এসি) মধুসূদন দাস আমাদের সময়কে বলেন, গ্রেপ্তার পাঁচজন জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য দিয়েছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
ডিবির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ঋণখেলাপি ব্যাংকার, চিকিৎসক, ব্যবসায়ীসহ অন্তত ৫০ ব্যক্তি এ চক্রের মাধ্যমে জাল এনআইডি তৈরি করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নতুন করে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন। এসব ব্যক্তি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি (ক্রেডিড ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্টে ঋণখেলাপি হওয়ায় নতুন করে ঋণ নিতে পারছিলেন না। এ চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে নতুন করে জাল এনআইডি দিয়ে ঋণ নিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করছিল। জাল এনআইডি তৈরি করতে ইসি কর্মীরা নিত ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। আর ব্যাংক ঋণের ১০ শতাংশ অর্থ পেত চক্রের সদস্যরা।
গত শনিবার মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডের ডি-ব্লক এলাকা থেকে দুই ইসি কর্মীসহ এই চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলো ইসির খিলগাঁও অফিসের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর ও গুলশান অফিসের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর আনোয়ারুল ইসলাম। তাদের সহযোগী মো. সুমন পারভেজ, মো. মজিদ ও আবদুল্লাহ আল মামুন। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে দ্বৈত, জাল ও ডুপ্লিকেট ১২টি জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়।
Leave a Reply