নির্বাচিত হওয়ার সাড়ে তিন মাস পর গত ১৬ মে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় মশক নিধন, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার, যানজট ও দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা বলেছিলেন। ৯০ দিনের প্রাথমিক পরিকল্পনায় নাগরিকদের মৌলিক সেবাগুলো নিশ্চিতের কথাও বলেছিলেন। দক্ষিণ সিটির বাসিন্দারা বলছেন, গত চার মাসের পরীক্ষায় অনেকটাই উতরে গেছেন ফজলে নূর তাপস। বেশ সাফল্য এসেছে মশক নিধনে। বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুতির মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থানের জানান দিয়েছেন। তবে অনেকেই বলছেন, সব মেয়রই প্রথমদিকে নানা আশার বাণী শোনান, উদ্যোগ নেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসবের ধারাবাহিকতা থাকে না।
মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরদিনই ফজলে নূর তাপস করপোরেশনের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা ইউসুফ আলী সরদারকে চাকরিচ্যুত করেন। এর দুদিনের মাথায় কর কর্মকর্তা আতাহার আলী খানকেও চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর পর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি প্রেষণে আসা করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক, প্রধান ভা-ার কর্মকর্তাসহ বেশ কিছু পদেও পরিবর্তন আনেন।
কয়েক বছর ধরে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু নিয়ে রাজধানীর মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন। গত বছর ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এর মধ্যেও মশার ওষুধ ও অন্য যন্ত্রাংশ ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর শেখ ফজলে নূর তাপস মশক নিধন কার্যক্রম ঢেলে সাজান।
সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রতিদিন চার ঘণ্টাব্যাপী প্রতি ওয়ার্ডে নির্ধারিত আটজন মশককর্মী বিভিন্ন স্থানে লার্ভিসাইডিং চালু করেন। অন্যদিকে দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এডাল্টিসাইডিং করা হয়। ফলে আতঙ্ক থাকলেও মশাবাহিত রোগটি এ বছর মারাত্মক আকার ধারণ করেনি। এমনকি মশার প্রকোপও অনেকটা কমে এসেছে। রাজধানীর বিভিন্ন অপরিচ্ছন্ন জলাশয় মশক উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। ইতোমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকার বিভিন্ন পুকুর ও জলাশয় চিহ্নিত করে সংস্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া উন্মুক্ত প্রায় দেড়শ কিলোমিটার নর্দমা প্রতিমাসে অন্তত দুবার পরিষ্কার করা হচ্ছে।
ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের ক্ষেত্রেও তাপসের গৃহীত পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত সফল হয়েছে। রাতের মধ্যে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে মনে করছেন নাগরিকরা।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই করপোরেশনের বিভিন্ন সেবাদানের ক্ষেত্রে শক্ত মনিটরিং চালু হয়েছে। ট্রেড লাইসেন্স, জন্ম নিবন্ধনসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন বন্ধ হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথাসময়ে অফিসে আসা ও যাওয়ার ক্ষেত্রেও বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহে একদিন মেয়র বিভিন্ন এলাকার উন্নয়ন কাজ তদারকি ও সরেজমিনে নানা সমস্যা দেখতে বের হন। এতে ঢাকা দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজেও গতি এসেছে। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানও করা হচ্ছে দ্রুত।
রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনেও কাজ শুরু করেছেন ফজলে নূর তাপস। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি খাল সংস্কারেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত ২২ জুলাই এক ভার্চুয়াল সভায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, জলাবদ্ধতা নিয়ে অন্য সেবা সংস্থাগুলো যে তথ্য দিচ্ছে, তা সঠিক নয়। পরে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামকে নিয়ে কয়েকটি স্থানে ঘুরে বক্তব্যের সত্যতাও তুলে ধরেন তিনি। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হয়েছিল।
শহরের পরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘ কয়েক বছর পর লাইসেন্সবিহীন রিকশাকে নিবন্ধনের আওতায় আনার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় প্রায় দুই লাখ রিকশাকে লাইসেন্স দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে করপোরেশন আয় হবে কয়েক কোটি টাকা। বিভিন্ন রাস্তায় অবৈধভাবে তৈরি হওয়া বেশ কয়েকটি মার্কেটও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই অবৈধ স্থাপনা ভাঙার কাজ চলছে। এ ছাড়া নানা অব্যবস্থাপনায় বেহাল পার্ক ও খেলার মাঠ আধুনিকায়নের কাজও আবার জোরেশোরে শুরু হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি কমিউনিটি সেন্টার ও এসটিএস নির্মাণের লক্ষ্যে কার্যক্রমও চলছে।
বিভিন্ন সেবা সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি ইন্টারনেট ও ডিশ ব্যবসায়ীরাও যত্রতত্র তার টানায় অনেকটা জঞ্জালে পরিণত হয়েছে রাস্তার দুপাশ। রয়েছে বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে দক্ষিণ সিটিকে তারের জঞ্জালমুক্ত করতে অবৈধ ক্যাবল অপসারণের জন্য প্রতিদিনই পরিচালনা করা হচ্ছে একাধিক মোবাইলকোর্ট।
সাধারণ নাগরিকরা তাপসের এ কার্যক্রমে আশাবাদী হলেও শঙ্কা রয়েছে অনেকের মনে। তারা বলছেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর জনপ্রতিনিধিরা কিছুদিন নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে উদ্যোগে ভাটা পড়ে। তবে ফজলে নূর তাপসের পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে দক্ষিণ ঢাকা পাল্টে যাবে। অপেক্ষার পালা, পূর্বসূরিদের মতোই তার উদ্যোগ থমকে যাবে, না ঢাকাকে বাসযোগ্য করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তা অব্যাহত থাকবে।
ঢাকার পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী ফয়সাল আলম বলেন, ফজলে নূর তাপসের উদ্যোগ আশাব্যঞ্জক। কিন্তু দেখতে হবে, এ উদ্যোগ কতদিন বলবৎ থাকে। ঢাকা দক্ষিণের আগের মেয়র সাঈদ খোকনও দায়িত্ব গ্রহণের পর নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে সে উদ্যোগ ধরে রাখতে পারেননি। ফলে বিদায়টাও সুখকর হয়নি।
আরমানিটোলা সমাজকল্যাণ সংসদের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন রনি বলেন, এ বছর মশার ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে সবাই আতঙ্কিত থাকলেও মেয়র শক্তভাবেই বিষয়টি সামাল দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত ফজলে নূর তাপসের নেওয়া সব উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তিনি নিজেই মাঠে গিয়ে সমস্যা চিহ্নিত করছেন, সমাধানের পথও বাতলে দিচ্ছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অবশ্যই দক্ষিণ ঢাকা বদলে যাবে।
দায়িত্ব গ্রহণের ৪ মাস অতিক্রান্ত হওয়া এ সময়কে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন জানতে চাইলে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আমার প্রিয় ঢাকাবাসীকে সেবা দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে আমি কাজ করে চলেছি। তাই এ করোনা মহামারীর মধ্যেও আমাদের কার্যক্রম স্তিমিত ছিল না। ঢাকাবাসীর মৌলিক সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার প্রাথমিক পরিকল্পনাকে প্রাধান্য দিয়ে তার বাস্তবায়নের পাশাপাশি আমরা দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আমাদের কর্মযজ্ঞের লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা শহরকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের একটি উন্নত রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা। সে যাত্রায় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রেরণার উৎস, আর ঢাকাবাসী সাহস সঞ্চারী সত্তা।
Leave a Reply