নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে তার নিজ ঘরে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টায় নির্যাতন করা এবং এ হীনকর্ম মোবাইল ফোনে ধারণ করে সেই ভিডিও সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য কাণ্ডে নাটের গুরু হিসেবে অভিযুক্ত দেলোয়ার হোসেন। র্যাবের হাতে সে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার একের পর এক কাণ্ডকীর্তিও বেরিয়ে আসছে। সর্বশেষ জানা গেছে, ধর্ষক দেলোয়ারের একটি নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী ছিল। এ বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে দেলোয়ারের নিজস্ব একটি গ্যাংও গড়ে উঠেছিল। প্রাণভয়ে এতদিন দেলোয়ারের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি যারা, স্থানীয় সেসব মানুষ এখন তার নানা অপকর্ম নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। জানা গেছে, সবজি বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। এর পর সন্ত্রাসীদের নিয়ে গড়ে তোলা সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে এলাকায় শুরু করে মাদকের কারবার এবং তা অবাধে চালিয়ে যেতে পুরো এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। লিডার দেলোয়ারের মতো তার গ্যাংয়ের সদস্যরাও খুন, ধর্ষণ, জবরদখলসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে যুক্ত ছিল।
এ তো গেল বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের যুবক দেলোয়ার হোসেন ও তার গ্যাংয়ের কথা। শুধু জয়কৃষ্ণপুরেই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানেই এখন এমন ভয়ানক গ্যাং দেখা যাচ্ছে। সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণের কা-ে সাইফুর বাহিনী, সাভারে প্রেম প্রত্যাখ্যাত হয়ে ভাইয়ের সামনে থেকে তুলে নিয়ে কিশোরী নীলা রায়ের খুনি মিজানুর রহমানের কিশোর গ্যাং, বরগুনায় প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় নয়ন বন্ডের জিরো জিরো সেভেন গ্রুপ- বেগমগঞ্জের দেলোয়ার বাহিনীরই নামান্তর। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে এসব গ্যাং গড়ে উঠছে। সম্প্রতি রাজধানীর এলাকাভেদে বেপরোয়া উত্থান ঘটেছে অনেক কিশোর গ্যাংয়ের; চলছে খুন-ধর্ষণসহ নানা অপকর্ম।
এসব বাহিনী হত্যা, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও মাদক কারবারের মতো অপরাধমূলক ও অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়। তাই তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বড় কোনো ঘটনায় সমালোচনার ঝড় উঠলেই কেবল সেই গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
গত বছরের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফকে তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে সন্ত্রাসীরা। এর পর তাকে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর সেদিন বিকালে তিনি মারা যান। পরের দিন ২৭ জুন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন। মূলত এ ঘটনার পর নয়ন বন্ডের নাম আলোচনায় উঠে আসে। এ নিয়ে যখন দেশজুড়ে তোলপাড়, তখন এ হত্যাকা-ের এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে হামলার মূলহোতা নয়ন বন্ড নিহত হন পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে। জেমস বন্ড সিরিজের অনুকরণে নয়ন বন্ড তার গ্যাং গড়ে তোলে। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা বরগুনায় মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অন্যতম হোতা ছিল। নয়ন বন্ডের মাদকবাণিজ্য ও সন্ত্রাসী কাজের পেছনে বরগুনা আওয়ামী লীগের একটি প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বন্ড গ্যাংকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগ উঠে আসে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতা ও তার ছেলের বিরুদ্ধে। নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পরও বরগুনায় বন্ধ হয়নি মাদক ব্যবসা। রাজনৈতিক ওই প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সমর্থনে গড়ে উঠেছে নতুন গ্যাং।
বরগুনা শহরের একাধিক সূত্র জানায়, শহরের পশ্চিম অংশে মাদক ব্যবসা নয়ন বন্ডের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তার সহযোগী ছিল রিফাত শরীফ হত্যার আসামি দুই ভাই রিফাত ফরাজী ও রিসান ফরাজী। একপর্যায়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তারা।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে বেড়াতে গিয়েছিলেন দক্ষিণ সুরমার এক দম্পতি। এ সময় কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ৫-৬ জন যুবক জোরপূর্বক কলেজের ছাত্রাবাসে নিয়ে যায় দম্পতিকে। সেখানে একটি কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে ১৯ বছরের গৃহবধূকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে তারা। খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে গৃহবধূকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে শাহপরাণ থানাপুলিশ। এ ঘটনায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও তিনজনকে আসামি করে শাহপরাণ থানায় মামলা করেন তরুণীর স্বামী। মামলার আসামি ছাত্রলীগকর্মী সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম ওরফে তারেক আহমদ, শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান ওরফে মাসুম গ্রেপ্তার হয়েছে। ইতোমধ্যে ধর্ষণের ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ঘটনার নাটের গুরু ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর রহমান। সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে স্থানীয় একটি ক্যাডার বাহিনী বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত ছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সাইফুরও এ বাহিনী গড়ে তোলেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক রাজনীতিকের ছত্রছায়ায়।
গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে ঘরে ঢুকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুরে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়। ঘটনার প্রায় এক মাস পর ৪ অক্টোবর ফেসবুকে ওই ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে দেশজুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে। নির্যাতিত ওই গৃহবধূ বাদী হয়ে ৯ জনকে আসামি করে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করেন। এ ঘটনার নাটের গুরু দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। দেলোয়ারের নেতৃত্ব গড়ে ওঠা ক্যাডার বাহিনী বেগমগঞ্জ দাপিয়ে বেড়াত। স্থানীয় রাজনৈতিক ছায়ায় গড়ে ওঠা দেলোয়ার বাহিনী ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। এক নারীকে নির্যাতনের পর তীব্র সমালোচনার পর তাদের অপরাধের নানা চিত্র উঠে আসতে শুরু করে গণমাধ্যমে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর রাত ৮টার দিকে সাভারে ভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় করে হাসপাতালে যাওয়ার পথে নীলা রায় নামে এক স্কুলছাত্রীকে ছিনিয়ে নেয় বখাটে মিজানুর। পরে ছুরিকাঘাতে নীলাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নীলার বাবা নারায়ণ রায় সাভার থানায় মিজানুর, তার বাবা আবদুর রহমান, মা নাজমুন্নাহার সিদ্দিকাসহ অজ্ঞাতনামা আরও চারজনকে আসামি করে মামলা করেন। পরে গ্রেপ্তার করা হয় মিজানুরকে। মিজানুর সাভারে কিশোর গ্যাং গড়ে তুলেছিল। এই গ্যাং ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজিসহ সাভার এলাকায় নানা অপরাধে যুক্ত ছিল।
রাজধানীতে বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী ও গ্রুপগুলোর পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনায় কিশোর গ্যাং। একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে শুধু রাজধানীতেই ৬০টির বেশি কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার তথ্য উঠে আসে। দুগ্রুপের সংঘর্ষে হতাহত, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, মাদক সেবন ও বিক্রি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত এসব কিশোর গ্যাং। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘গ্যাং কালচার’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। ‘নাইন স্টার’, ‘ডিসকো বয়েজ’, ‘নাইন এমএম বয়েজ’, ‘একে ৪৭’, ‘ফাইভ স্টার’, ‘লাড়া দে’, ‘লেভেল হাই’, ‘কোপাইয়া দে’, ‘পাওয়ার বয়েজ’, ‘কোবরা’ অন্যতম। এসব কিশোর গ্যাংকে রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের ছায়া দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, দৃশ্যত ধর্ষণ ও নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এসব ঘটনায় স্থানীয় বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার তথ্যও বেরিয়ে আসছে। এসব গোষ্ঠী বা বাহিনী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে। এ পৃষ্ঠপোষকতাই তাদের দানবে পরিণত করে। যা-ই করি না কেন, আমার কিছুই হবে না- এই ভাব জাগে মনে। বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা এসব প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রভাবকে বিবেচনা করা যাবে না। এ ছাড়া পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানা উদ্যোগের মাধ্যমে এসব গ্যাংয়ের গজিয়ে ওঠা প্রতিরোধ করতে হবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, যখনই কোনো অপরাধী চক্রের অপতৎপরতা নজরে আসে, তখনই আমাদের তরফে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে কারও কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তি আমাদের বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য হিসেবে নেওয়া হয় না।
Leave a Reply