নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রকৃত তথ্য আড়ালসহ বিভিন্ন ধরনের কারসাজির মাধ্যমে কিছু গ্রাহকের পকেটে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে সরকারি মালিকানাধীন ৪ বাণিজ্যিক ব্যাংক। মাত্র ৬৯ গ্রাহকের পকেটেই তুলে দিয়েছে ৩৮ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা ঋণ। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে একক গ্রাহককে ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া যায় না। কিন্তু গ্রাহকদের সন্তুষ্ট করতে এই নীতি লঙ্ঘন করেও ঋণ দেওয়া হয়েছে। মোটা অঙ্কের ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি বিশেষ ছাড়ে ঋণ পুনঃতফসিল, সুদ মওকুফসহ যাবতীয় সুবিধা দিয়েছে। এরপর অতিভাগ্যবান গ্রাহকরা ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারি ব্যাংকগুলো সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে মাত্র ৬৯ গ্রাহক পেয়েছেন সাড়ে ২২ শতাংশ ঋণ। ব্যাংকিং নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিলে তাকে বৃহৎ ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর একক গ্রাহককে কোনোভাবেই ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। ৬৯ গ্রাহকের মধ্যে ১৯ গ্রাহককে ব্যাংকিং আইন লঙ্ঘন করে
অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে। বৃহৎ অঙ্কের ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ৪৫টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতের আর ২২টি বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। আইন লঙ্ঘন করে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ১২টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ৭টি সরকারি প্রতিষ্ঠান।
সোনালী ব্যাংক : চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ঋণের পরিমাণ ৪৭ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১ বৃহৎ ঋণগ্রহীতার কাছে দিয়েছে ১০ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ২২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। নিয়ম ভেঙে মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে ৮টি প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে ৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের বিশেষ বিবেচনায় পুনর্গঠন, পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফ দেওয়ার পরও শীর্ষদের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ১৭ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ ৯ হাজার ৮৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৯ শতাংশেরও বেশি।
জনতা ব্যাংক : সাম্প্রতিক নানা অনিয়মের জন্য আলোচিত জনতা ব্যাংক ২২ গ্রাহকের পকেটে তুলে দিয়েছে ১০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের ২০ জন বেসরকারি খাতের। বৃহদাঙ্কের ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১০ হাজার ৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ শীর্ষ গ্রাহকদের দেওয়া প্রায় শতভাগ ঋণই খেলাপি। আইন লঙ্ঘন করে ৫ গ্রাহককে দেওয়া হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ। এর মধ্যে ৪ গ্রাহকই বেসরকারি খাতের। জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি ৫২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ২৫ শতাংশ বা ১৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে, যা দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। আলোচিত ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
অগ্রণী ব্যাংক : বেসরকারি খাতের ৭ উদ্যোক্তাসহ সর্বমোট ৯ গ্রাহকের পকেটে ৮ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ২১ শতাংশ। ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে দুই প্রতিষ্ঠানকে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংক ৪২ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। জুনে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির এমডি মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে আদায় অনেক খারাপ পরিস্থিতি। বড় বা ছোট সব গ্রাহকই নানা কারণে ঋণ ফেরত দিতে পারছেন না। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের ক্ষতির দিকটা বিবেচনার পাশাপাশি ঋণ আদায়ের জন্য।
রূপালী ব্যাংক : রূপালী ব্যাংক জুন পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ৩০ দশমিক ৬৪ শতাংশ তুলে দিয়েছে ১৭ শীর্ষগ্রহীতার পকেটে। বৃহদাঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। এই টাকার বেশিরভাগ পেয়েছেন বেসরকারি খাতের ১৩ উদ্যোক্তা। নিয়মের বাইরে ঋণসুবিধা দেওয়া হয়েছে ৪ গ্রাহককে; এর মধ্যে ৩ জনই বেসরকারি খাতের। জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি ২৯ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৪ হাজার ৪৪ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ।
দীর্ঘসময় ধরে ঋণশৃঙ্খলা পরিপালন না করে ঋণ বিতরণ করায় খেলাপি ঋণে ধুঁকছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। হাতেগোনা গ্রাহকদের পকেটে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়ে তা আর আদায় করতে পারছে না। আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তাদের নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতেও বড় গ্রাহকের পকেট থেকে অর্থ ফেরত আসছে না। খেলাপি ঋণ কমাতে বাধ্য হয়ে হিসাব থেকে বাদ দিতে অবলোপন করা হচ্ছে। অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে আদালতে মামলা করেও তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। অবলোপন করা ঋণ আদায়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ৬/৭ বছর ধরে চুক্তি করছে ব্যাংকগুলো। সোনালী ব্যাংক ৭০৫ কোটি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৩১ কোটি, জনতা ব্যাংকের ৫শ কোটির বিপরীতে ১২ কোটি, অগ্রণী ৫৫১ কোটির বিপরীতে ১৫ কোটি ও রূপালী ব্যাংক ৬০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় করেছে মাত্র ১ কোটি টাকা। আদায় করতে না পারায় ব্যাংকগুলোর মুনাফা কম হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে লোকসান হচ্ছে। এ জন্য সরকারি ব্যাংকগুলোয় লোকসানি শাখাও বেশি। জুন পর্যন্ত লোকসানি শাখা দাঁড়িয়েছে ৫০, জনতার ৭৯, অগ্রণীর ৭৮ এবং রূপালী ব্যাংকের লোকসানি শাখা ১৬টি।
Leave a Reply