প্রথমবারের মতো একেবারেই ভিন্ন একটি পদ্ধতিতে এ বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু এ ধরনের পদ্ধতিতে ফল মূল্যায়নের পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা নেই শিক্ষা বোর্ডের। এ কারণে এ নিয়ে তাদের সামনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কীভাবে ফল মূল্যায়ন করলে শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে- এ বিষয়টি এখন শিক্ষা বোর্ডের সামনে চলে এসেছে। এ প্রেক্ষাপটে ফল তৈরি করতে গিয়ে অনেক প্রশ্নের সমাধান খুঁজছেন শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। আজ রবিবার এ ব্যাপারে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের আদেশ জারি করার কথা রয়েছে। ওই কমিটিই ফল মূল্যায়নের রূপরেখা দেবে। তাদের দেখানো রূপরেখা অনুযায়ী তৈরি হবে সাড়ে ১৩ লাখ শিক্ষার্থীর এইচএসসির ফল।
করোনা সংক্রমণের কারণে এ বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা বাতিল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে তাদের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা এবং মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে। মূল্যায়ন পদ্ধতি তৈরির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমিটির ‘মূল্যায়ন পদ্ধতি’ অনুযায়ী উচ্চ মাধ্যমিকের ফল তৈরি করা হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে ফল প্রকাশের লক্ষ্য জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, এইচএসসির ফল নিরূপণ পদ্ধতি সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে আজ প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে কমিটি গঠনের বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়েছে, কমিটির প্রধান হবেন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। সদস্য সচিব থাকবেন বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। সদস্য করা হবে শিক্ষাবিদ, শিক্ষা বোর্ড, প্রকৌশল, মেডিক্যাল, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের।
নতুন এ পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা কারিকুলাম গবেষক খায়রুল আলম মনির আমাদের সময়কে বলেন, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকার তৎকালীন শিক্ষার্থীদের বিশেষ বিবেচনায় অটো পাস দিয়েছিল। বর্তমান যে প্রেক্ষাপট তা যুদ্ধের চেয়ে কম নয়।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে ফল প্রকাশ সহজ হয়েছে শিক্ষা বোর্ডের জন্য। এখন পাবলিক পরীক্ষার যে পদ্ধতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটি সহজ নয়। কারণ সায়েন্স, আটর্স, কমার্স, কারিগরি, মাদ্রাসা নানা বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে আসা শিক্ষার্থীদের পেছনের ফল দিয়ে মূল্যায়নে অনেক বিষয়ে নিয়ে এগোতে হবে দায়িত্বশীলদের। তবে যত কঠিনই হোক শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের স্বার্থে আমাদের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তটিই নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যে সারাবিশ্বে কোথাও পাবলিক পরীক্ষা হচ্ছে না। সরকার নতুন পদ্ধতিতে ফল তৈরির কথা জানিয়েছে। আশা করব সরকার একটি ভালো দিকনির্দেশনা দেবে। তাদের মূল্যায়ন কীভাবে হবে, তারা যেন অটো পাস কথাটা না বলতে পারে। ফলটা মূল্যায়নের ভিত্তিতেই হবে, তার মধ্যে কারও ফল ভালো হতে পারে, আবার কারও খারাপ হতে পারে। এটি যে কোনো পরীক্ষায় হতে পারে।
একটি শিক্ষা বোর্ডের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এবারের এইচএসসি পরীক্ষার যে ফল প্রকাশ করা হবে, এটি একেবারেই নতুন একটা পদ্ধতি। এমন ফল তৈরির অভিজ্ঞতা নেই বোর্ডের। তার পরও একটি গাইডলাইন তৈরি পর ফল তৈরির কাজটা একটু সহজ হবে।
তিনি বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষা না হয়ে যদি জেএসসি ও এসএসসি পর্যায়ের হতো মূল্যায়নের কাজটা অনেক সহজ ছিল। বোর্ড কর্মকর্তাদের এখন অনেক প্রশ্নে সামনে রেখে কাজ করতে হচ্ছে। যেমন- জেএসসি ও এসএসসির অনেক বিষয় আছে, যেগুলো উচ্চ মাধ্যমিকের সঙ্গে মিল নেই। আবার কোনো শিক্ষার্থী আগে মাদ্রাসায় ছিল, দাখিলের পর কলেজে এসেছে। আবার ভোকেশনাল থেকেও কলেজে আসে। আছে বিভাগ পরিবর্তনের বিষয়। এ ছাড়া অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া কী হওয়া উচিত? কিছু শিক্ষার্থী আছে গত বছর কাক্সিক্ষত জিপিএ না পাওয়ায় এবার আবারও পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। তাদের তো একটা ফল আছে, এখন তার ক্ষেত্রে কী মূল্যায়ন হবে? এর পরও কাজ করতে গিয়ে আমাদের সামনে অনেক প্রশ্ন চলে আসবে।
এ বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি, ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৭টি বিষয়ে ১৩টি পত্রের পরীক্ষা হয়। ৭টি বিষয়ের সঙ্গে এসএসসির কয়েকটি বিষয়ের মিল আছে। আবার কতগুলো বিষয়ের মিল নেই। এ জন্য আমরা বিষয়ভিত্তিক ম্যাপিং করার চেষ্টা করব।
এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করেছিল ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১০ লাখ ৭৯ হাজার ১৭১ জন নিয়মিত এবং দুই লাখ ৬৬ হাজার ৫০১ জন অনিয়মিত পরীক্ষার্থী রয়েছে। অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এক বিষয়ে ফেল করেছিলেন ১ লাখ ৬০ হাজার ৯২৯ জন, দুই বিষয়ে ৫৪ হাজার ২২৪ জন এবং সব বিষয়ে ৫১ হাজার ৩৪৮ জন ফেল করেছিলেন। এ ছাড়া ৩ হাজার ৩৯০ জন প্রাইভেট পরীক্ষার্থীরও এবার এইচএসসিতে অংশে নেওয়ার কথা ছিল। এর সঙ্গে গতবার পাস করলেও আরও ভালো ফলের জন্য এবার পরীক্ষায় অংশ নিতে চেয়েছিলেন ১৬ হাজার ৭২৭ শিক্ষার্থী।
নিয়মিত রুটিন অনুযায়ী এ পরীক্ষা গত ১ এপ্রিল হওয়ার শুরু হওয়ার কথা ছিল। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে পরীক্ষা বাতিল করতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত।
Leave a Reply