চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে সরকারের কাছে তথ্য আছে। এ ইস্যুতে রাজপথে সক্রিয় আছে এমন কয়েকটি পক্ষের সঙ্গে ‘তৃতীয় পক্ষ’ ঢুকে গেছে বলে গোয়েন্দা সূত্র থেকে সরকারের সর্বোচ্চ মহলে খবর এসেছে। কিন্তু সামাজিক এই আন্দোলনকে কোনোভাবেই ভিন্ন খাতে নিতে দেবে না সরকার। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই ইস্যুতে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে সরকার সমর্থক বেশ কয়েকটি সংগঠন ও ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে ক্যাম্পাস দখলে রেখেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সামাজিক এই আন্দোলনে মাঠে আছে। প্রতিদিনই তাদের কর্মসূচি থাকছে। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের নেতৃত্বে ছাত্র অধিকার আন্দোলন ব্যাপক সক্রিয় এই আন্দোলনে। মাঠে আছে বামপন্থী দলগুলো। হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামি দলও ধর্ষকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে প্রতিদিনই।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এক নারীর নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে গতি পায়। আগে থেকে সিলেটের এমসি কলেজে গণধর্ষণের ঘটনায় আন্দোলন চলে আসছিল। আন্দোলনকারীরা ধর্ষণকা-ে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু আন্দোলনকে কোনো কোনো মহল রাজনীতিকরণ করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
মাঠ পুলিশের কর্মকর্তাদের কাছে আসা একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ষণের মতো সামাজিক আন্দোলনের ওপর ভর করে কোনো কোনো মহল এটিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দিতে চাইছে। সামাজিক আন্দোলনে ঢুকে সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো গণআন্দোলন গড়ে তোলারও চক্রান্ত করা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী মাঠ পুলিশের কর্তাব্যক্তিরাও ধর্ষণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সামাজিক আন্দোলনের ওপর নিবিড় নজরদারি করছেন। বিশেষ করে সামাজিক আন্দোলনকে সরকারবিরোধী সহিংস আন্দোলনে রূপ দিতে কেউ পেছন থেকে হাওয়া দিচ্ছে কিনা এ ব্যাপারে খোঁজখবর রাখছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ধর্ষণকা-ের মতো একটি ঘৃণিত অপরাধের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সামাজিক আন্দোলনে তাদেরও সমর্থন রয়েছে। তারা চান ধর্ষণকা-ে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। কিন্তু এই আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চলছে। দেশের পাশাপাশি কেউ-কেউ বিদেশ থেকেও উস্কানি দিচ্ছে। এ ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছি।
শনিবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক লিখিত বক্তব্যে পুলিশ সদর দপ্তর বলেছে, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন ইস্যুতে নানা প্রতিবাদকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপতৎপরতা চলছে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল জনগণের প্রত্যাশাকে কৌশলে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে গোষ্ঠী ও দলগত হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। দেশের শান্তিশৃঙ্খলার স্বার্থে এবং উন্নয়নের চলমান ধারা অব্যাহত রাখতে রাষ্ট্রবিরোধী যে কোনো কর্মকা- সতর্কভাবে পরিহারের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধও জানানো হয় পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে গত শুক্রবার রাজধানীর বায়তুল মোকাররম থেকে সমমনা কয়েকটি ইসলামি দল ও সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। ওই বিক্ষোভ মিছিল থেকে ধর্ষণকা-ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি সরকারবিরোধী নানা স্লোগান দেওয়া হয়। কেউ কেউ সরকার পতনের আন্দোলনেরও ডাক দেন স্লোগানে। ওই বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থা পুলিশকে সজাগ করে দিয়ে বলেছিল, এই সামাজিক আন্দোলনে ঢুকে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা করার অপচেষ্টা হতে পারে। এ তথ্য জানার পর মাঠ পুলিশকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে দেখা যায়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল রবিবার বলেছেন, ধর্ষণবিরোধী শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকারের সমর্থন রয়েছে। তবে এই আন্দোলনের নামে পরিস্থিতি নষ্ট করলে এবং সহিংসতা ছড়ালে কঠোর হবে সরকার।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি বারবার আন্দোলনের ডাক দিয়ে তারা জনগণের সাড়া পায়নি। এরপরও বারবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। তাদের ডাকে মানুষের আস্থা নেই। মানুষের সাড়া না পেয়ে একবার কোটা আন্দোলন, অন্যবার নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ওপর ভর করেছিল। এখন ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ওপর তারা ভর করেছে।
বিএনপি যত অপচেষ্টাই করুক তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায় রূপান্তরিত হবে। সরকার নারী নির্যাতনসহ যে কোনো অপরাধের কঠোর অবস্থানে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনগণের সম্পৃক্ততা যদি কোনো আন্দোলনে না থাকে তা হলে সেই আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য।
শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সরকার কোনো বাধা দেবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিন্তু আন্দোলনের নামে পরিস্থিতি নষ্ট করতে চাইলে, সহিংসতা ছড়ালে; জনগণের জানমালের নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকার কঠোর হবে।
এ দিকে চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন কোনোভাবে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করার চেষ্টা হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে দলটির নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলটির কেন্দ্রের এই নির্দেশনা অনুযায়ী ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা আপাতত মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে পরিস্থিতি বুঝে তারা কর্মসূচির ব্যাপকতা বাড়াতে চাইছে। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায়ও ধর্ষণকা-ের বিষয়টি আলোচনা আসে। সেখানে নারীকল্যাণে কর্মসূচি গ্রহণের প্রস্তাব আসে।
বিএনপির নীতির্ধিারকেরা বলছেন, এই আন্দোলনকে পুঁজি করে কোনো ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা তাদের নেই। সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি মাঠে আছে। আপাতত দল গোছানোর দিকে তাদের নজর।
অবশ্য, দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, তারা আন্দোলনকে খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে বলা হয়েছে। নারী নির্যাতনবিরোধী একটি মঞ্চ তৈরির কথাও দলে আলোচনা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আন্দোলন বড় আকার ধারণ করলে বিএনপি মাঠে তাদের কর্মসূচি বাড়াতে পারে। আর অন্য আন্দোলনের মতো এই আন্দোলনও সময়ের গতিতে ভাটা পড়তে থাকলে তাদের কর্মসূচিও কমতে থাকবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, করোনা মহামারীর মধ্যে সারাদেশে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ধর্ষণের যে মহামারীর সৃষ্টি করেছেন; তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন তারা। শান্তিপূর্ণভাবে তাদের নেতাকর্মীরা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য হচ্ছে- তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর পুরনো ফর্মুলা।
Leave a Reply