প্রতিবছরই রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উঠে আসে অডিট দলের প্রতিবেদনে। এসব দুর্নীতিতে যুক্তদের দায়ী করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে বছরের পর বছর দুর্নীতি-অনিয়ম করেই পার পেয়ে যান দুর্নীতিবাজরা। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি বা সরকারি হিসাব সংক্রান্ত কমিটি (পিএসি) অডিট আপত্তি নিষ্পতিতে ভূমিকা রাখতে পারছে না। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়কে আরও গতিশীল করতে হবে। আপত্তি নিষ্পত্তি করতে সংশ্লিষ্টদের বারবার তাগিদ দিতে হবে।
কর্মকর্তারা জানান, সিএজি কার্যালয়ের অধীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ অডিট অধিদপ্তরের ১১টি অডিট দল ২০১৮-১৯ অর্থবছরের অডিটে স্বাস্থ্য খাতে পৌনে ৪ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছে। দৈনিক আমাদের সময়ে এ সংক্রান্ত চার পর্বে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। বিপুল অঙ্কের এই অনিয়ম-দুর্নীতি শুধু স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) ও ১৭টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের। এ ছাড়াও অডিট করা হয়েছে সকল সিভিল সার্জন কার্যালয়, জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসমূহে। অডিট করা হয়েছে ২২টি বিশেষায়িত হাসপাতালও। এসব প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পেলে এই অঙ্ক আরও বড় হবে বলে জানান কর্মকর্তারা। চলতি বছরের মার্চ মাসে এই ২২টি প্রতিষ্ঠানের অডিট শেষে জুলাইয়ে প্রাথমিক অডিট রিপোর্ট পেশ করেন কর্মকর্তারা। অডিট পরিচালনা করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ অডিট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজিজুর রহমান, পরিচালক খায়রুল ইসলাম ও সেক্টর ১-এর উপপরিচালক মো. আবদুর রহমান। এই তিন কর্মকর্তা অত্যন্ত সৎ, সাহসী ও নিষ্ঠাবান হিসেবে বেশ পরিচিত। তারা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ৫ গুণ বেশি অনিয়ম তুলে এনেছেন।
কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিবছরই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উঠে আসে। এসব ঘটনায় হাজার হাজার কোটি টাকা জড়িত। দায়ী কর্মকর্তারা দুর্নীতি করে চাকরি জীবন শেষে চলেও যান। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অডিট আপত্তি নিষ্পতি হয় না। ফলে সরকারি অর্থের আর হদিস মেলে না।
বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলছেন। তাদের ভাষ্য, প্রতিবছরই রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ করে অডিটর জেনারেলের কার্যালয়। কিন্তু এসব রিপোর্টের বিপরীতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে কর্মকর্তারা শ্রম-ঘাম দিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে আনলেও নানা জটিলতার মারপ্যাঁচে দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না অনেক সময়। অনেকে অডিট আপত্তি পাশ কাটিয়েই চাকরি জীবন শেষ করে চলে যান। সুতরাং অডিট আপত্তি আরও দ্রুত কীভাবে নিষ্পত্তি করা যায় তা নিয়ে ভাবতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত সারা জীবনই দুর্নীতির আখড়া। এই খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। অডিটে যেসব দুর্নীতি উঠে আসে তার বেশিরভাগই নিষ্পত্তি হয় না।
কেন গুরুতর এসব অনিয়ম নিষ্পত্তি হয় না এমন প্রশ্নে সাবেক এই সিএজি বলেন, অডিট রিপোর্টগুলো নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। সিএজি রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর এগুলো আলোচনার জন্য সংসদে জমা দেওয়া হয়। এর পর পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি বা সরকারি হিসাব সংক্রান্ত কমিটি (পিএসি) আলোচনা করে নিষ্পত্তির জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু অডিট রিপোর্ট সংসদে জমা দেওয়া হলেও তা নিয়ে সংসদে খুবই কম আলোচনা হয়। আর পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিতে আলোচনা হলেও তাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় না। ফলে এসব অডিট প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। অপরাধীরা একটা সময়ে পার পেয়ে যায়। তবু পিএসিকে ঘন ঘন সভা করতে হবে। আপত্তি নিষ্পত্তির তাগাদা দিতে হবে। এ ছাড়া সংসদীয় কমিটিতেও এসব বিষয় নিয়ে জোরালো আলোচনা করতে হবে বলে জোরালো মত দেন তিনি।
হাফিজউদ্দিন আরও বলেন, সিএজি কার্যালয়ের সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে। অডিট আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় যুগ যুগ ধরেই এসব অনিয়ম অডিট দল বের করবে কিন্তু কোনো সুরাহা হবে না।
আপনি সিএজি থাকাকালে সিস্টেম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি বহুবার বহু ফোরামে এসব নিয়ে আলোচনা করেছি। গলদের এই সিস্টেম পরিবর্তনের জন্য লড়েছি। কিন্তু আমার কথা কেউ শোনেনি।
একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, অডিট রিপোর্টগুলো নিষ্পত্তিতে পিএসি কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তারা ঘন ঘন মিটিং করে আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য দায়ীদের চাপ দিতে পারে। কিন্তু বর্তমান পিএসি খুব একটা সক্রিয় নয়। প্রতিমাসে কমপক্ষে ২টা মিটিং করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বর্তমান কমিটি দুই-তিন মাসে মাত্র ১টি মিটিং করে। গত ৭-৮ মাস ধরে কোনো মিটিংই হয়নি। কমিটির মিটিংগুলো নিয়মিত হলে অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির গতি আরও বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে জানতে পিএসির সভাপতি সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজীকে কয়েকবার ফোন করা হলেও সাড়া মেলেনি। পরিচয় দিয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।
পিএসির সদস্য ও জয়পুরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন আমাদের সময়কে বলেন, করোনার কারণে অনেক মিটিং হয়নি। করোনার আগে যেসব মিটিং হয়েছে সেগুলোয় বড় বড় বেশ কিছু অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দিয়েছি। মিটিংয়ের ফলোআপ নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করতে সচেষ্ট আছি।
কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কার্যালয়ের কর্মকর্তারা আমাদের সময়কে জানান, অডিট রিপোর্ট কার্যকর অর্থাৎ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১০ পর্যন্ত সকল অনিষ্পন্ন সাধারণ অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করার আদেশ দিয়েছেন বর্তমান অডিটর জেনারেল মুসলিম চৌধুরী। তা ছাড়া সংসদে হালনাগাদ অডিট রিপোর্ট পেশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গতানুগতিক অডিট না করে ইস্যুভিত্তিক বিভিন্ন গুরুতর অনিয়মের অডিট করার জন্য ইতোমধ্যে আদেশ জারি করা হয়েছে। চলতি মাসেই ১৭টি অডিট অধিদপ্তরের আওতায় ৪৯ মন্ত্রণালয়-বিভাগে গুরুতর ইস্যুভিত্তিক অনিয়মের অডিট শুরু হবে। ব্যতিক্রমধর্মী এ ধরনের অডিটের মাধ্যমে সমসাময়িক অনিয়ম এবং দুর্নীতিগুলো উঠে আসবে বলেও তিনি আশা করেন। এতে অডিট অনেক ফলপ্রসূ হবে এবং যারা অনিয়মে জড়িত তারা পার পাবেন না।
তারা জানান, নিয়মানুযায়ী অডিটে উঠে আসা অনিয়মকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। গুরুতর অনিয়ম (এপি) এবং বিধি ও পদ্ধতিগত (জেপি)। গুরুতর অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে খুব শিগগিরই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে চিঠি দেওয়া হবে। আর বিধি ও পদ্ধতিগত অনিয়মগুলো নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অফিসপ্রধানদের চিঠি দিয়ে জানানো হবে। চলতি সপ্তাহে এসব চিঠি দেওয়া হবে। উভয় প্রকার অনিয়ম, যেগুলো নিষ্পত্তি হবে না সেগুলো মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে রিপোর্টভুক্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হবে সরকারি হিসাব সংক্রান্ত কমিটিতে আলোচনার জন্য।
Leave a Reply