ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌরসভার আসন্ন নির্বাচনে সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান শুভ্রকে শনিবার রাতে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। পৌরসভার পানমহাল এলাকায় সেই সময় তিনি গণসংযোগ করছিলেন।
হামলায় তার দুই সঙ্গীও আহত হন, তাদেরকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাদের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত নয়। শুভ্র বিআরডিবি গৌরীপুরের চেয়ারম্যান ছিলেন।
এ ঘটনায় মইলাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির (একাংশের) যুগ্ম আহ্বায়ক রিয়াদুজ্জামান রিয়াদকে রোববার ভোরে তারাকান্দা উপজেলার হারিগাছা থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এছাড়াও মইলাকান্দার কাউরাট এলাকা থেকে জাহাঙ্গীর আলম ও রাসেলসহ তিনজনকে গ্রেফতারের তথ্য জানিয়েছেন গৌরীপুর থানার ওসি মো. বোরহান উদ্দিন।
এ হত্যাকাণ্ডে গৌরীপুর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ রফিকুল ইসলামের ইন্ধন রয়েছে অভিযোগ তুলে দুপুরে তার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, তার ভাই সৈয়দ তৌফিকুল ইসলামের বাড়ি, আরেক ভাই সৈয়দ মাজহারুল ইসলাম জুয়েলের ফার্নিচারের দোকানে আগুন দিয়েছে ক্ষুব্ধ জনতা।
এর আগে তারা উপজেলা বিএনপির একাংশের আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণ ও তার ভাই রিয়াদুজ্জামান রিয়াদ এবং তাদের কয়েক আত্মীয়ের বাড়িতে ভাংচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে তারা।
বিক্ষুব্ধরা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো. রফিকুল ইসলাম ও প্রতিবেশী আনোয়ার হোসেন চন্দনের বাসা-বাড়িও ভাংচুর করে।
দপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, দূরে দূরে অবস্থিত এসব বাড়ির কোনোটিতে আগুন জ্বলছে, কোনোটির আগুন নিভু নিভু। ময়মনসিংহ ও ঈশ্বরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, বিকালে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
হত্যায় জড়িতদের বিচার দাবিতে শহরে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। মিছিল শেষে দুপুরে গৌরীপুর থানা ঘেরাও করে তারা।
এসব ঘটনায় পুরো এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। শহরের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে যান চলাচলও। শহরজুড়ে অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।
বিক্ষোভ হয়েছে নান্দাইল ও ত্রিশালেও। নান্দাইলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ টায়ার জ্বালিয়ে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করে। ত্রিশালেও ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে নেতাকর্মীরা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ২নং গৌরীপুর ইউনিয়নের গজন্দর গ্রামের হামিদুর রহমানের ছেলে শামীম আহাম্মেদ (৩৭) জানান, রাত ১০টার দিকে পান মহালের আবদুর রহিমের চায়ের দোকানে শুভ্রসহ ৪-৫ জন চা পান করছিলেন।
এ সময় দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এসে সামনে থামে। মইলাকান্দা ইউপি চেয়ারম্যান রিয়াদুজ্জামান রিয়াদসহ ৭-৮ জন এসব অটোরিকশা থেকে নামেন। হঠাৎ করে এদের দু’জন বড় দা নিয়ে শুভ্রকে কোপ দিতে আসে।
তিনি দ্রুত সরে গেলে চায়ের দোকানের খুঁটি কেটে যায়। শুভ্র চিৎকার দিলে ওই দু’জন দৌড়ে পালিয়ে যায়। তবে অন্যরা শুভ্রর ওপর আক্রমণ চালায়। শুভ্র বাঁচার জন্য দৌড়ে পালাচ্ছিলেন।
তিনি মসল্লা মহালের সুমিত্রা মেডিকেল হলের সামনে যেতেই দুর্বৃত্তরা তাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। শুভ্রর সঙ্গে থাকা আল আমিন ও জাহাঙ্গীরকেও কোপায় তারা।
সুমিত্রা মেডিকেল হলের মালিক নৃপেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস জানান, শুভ্রকে তাড়া করে দু’দিক থেকে ৩ জন আসে। শুভ্র দোকানে এসে পড়ে যায়। আশপাশের লোকজন তখন বেঞ্চ দিয়ে হামলাকারীদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে।
কিন্তু তা উপেক্ষা করেই তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। গৌরীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক ডা. দীপঙ্কর চক্রবর্তী জানান, তিনজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় এ হাসপাতালে আনা হয়।
প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত তাদেরকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। গৌরীপুর থানার ওসি বোরহান উদ্দিন জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ১১টায় মাসুদুর রহমান শুভ্র মারা যান।
ময়নাতদন্ত শেষে রোববার দুপুর ২টার দিকে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তার লাশ বাড়িতে নিয়ে গেলে স্বজনদের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। বহু মানুষ তাকে একনজর দেখার জন্য বাড়িতে ভিড় করেন।
গৌরীপুর পৌর ঈদগাহ মাঠে বিকাল ৫টায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় অর্ধলাখ মানুষ এতে অংশ নেন। ঈদগাহ মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় পাশে স্টেডিয়াম মাঠেও জানাজায় দাঁড়াতে হয়।
জানাজা পড়ান শুভ্রর ছোট ভাই আবেদুর রহমান বাবু। পরে গৌরীপুর ইউনিয়নের বায়ড়াউড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
জানাজার আগে সেখানে বক্তব্য দেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক একেএম আবদুর রফিক, সাংগঠনিক সম্পাদক শরীফ হাসান অণু, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক মুর্শেদুজ্জামান সেলিম, উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মোফাজ্জল হোসেন খান, উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. হেলাল উদ্দিন আহাম্মেদ, যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হোসেন জুয়েল, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, আব্দুল মুন্নাফ, জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান খোকন, সাধারণ সম্পাদক উত্তম চক্রবর্তী রকেট, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মো. সানাউল হক, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মো. সোহেল রানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপস। পরিবারের পক্ষে শুভ্রর চাচা সাদেকুর রহমান সেলিম ও খলিলুর রহমান বক্তব্য দেন। এ ঘটনায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। সেই সময় শুভ্রর চাচা সাদেকুর রহমান সেলিম যুগান্তরকে বলেন, আমরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এদিকে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আহমার উজ্জামান ও গৌরীপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাখের হোসেন সিদ্দিকী।
তারা দোষীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দেন। একই আশ্বাস দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান মারুফও।
কী কারণে শুভ্রর ওপর হামলা : কী কারণে শুভ্রর ওপর হামলা চালানো হয়েছে তা পুলিশ বা পরিবারের কেউ রোববার রাত পর্যন্ত বলতে পারেননি।
উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মো. সোহেল রানা যুগান্তরকে বলেন, জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী পালনকে কেন্দ্র করে মে মাসে শুভ্রর সঙ্গে রিয়াদের হাতাহাতি হয়েছিল। সে কারণে রিয়াদ এ হামলা চালাতে পারে। তবে সেটিই কারণ বলা যাচ্ছে না।
উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মোফাজ্জল হোসেন খান যুগান্তরকে বলেন, আসন্ন পৌর নির্বাচনে শুভ্রর প্রার্থী হওয়া নিশ্চিত ছিল। তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
তার জয়লাভ করাও প্রায় নিশ্চিত ছিল। এজন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে। এতে অবশ্যই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কারও ইন্ধন বা ষড়যন্ত্র রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, বিএনপির কর্মকাণ্ডও তেমন নেই। এ অবস্থায় বিএনপি নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার ওপর প্রকাশ্যে হামলা চালানোর সাহস এমনিতেই পাননি।
Leave a Reply