সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে মারা যাওয়া রায়হানের গায়ের জামাও পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। মর্গে গিয়ে নিহত ছেলের গায়ে অন্য জামা দেখে তখনই প্রশ্ন তুলেছিলেন তার মা সালমা বেগম। গতকাল শুক্রবার আমাদের সময়কে তিনি এ কথা জানান।
এদিকে, এতদিন পরও রায়হান হত্যার কারণ জানতে পারেনি পুলিশ। পিবিআই বলছে, ঘটনায় জড়িত পুলিশ কনস্টেবল টিটুকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, শিগরিগই হত্যার কারণ জানা যাবে। একই সঙ্গে প্রধান অভিযুক্ত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই (বরখাস্ত) আকবর হোসেন ভূইয়াকে গ্রেপ্তারে প্রশাসনের একাধিক টিম কাজ করছে। মহানগর পুলিশের শীর্ষ এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এসআই আকবরের সঙ্গে নিহত রায়হানের শত্রুতা ছিল কিনা তা এখনো জানা যায়নি। তবে ঘটনার সঙ্গে আকবর জড়িত ছিল বলেই সে পালিয়েছে। তিনি বলেন, এসআই আকবরের পাশাপাশি সিসিটিভির ফুটেজ গায়েব করার অপরাধে কোম্পানীগঞ্জের এক সাংবাদিককেও খুঁজছে পুলিশ।
বন্দরবাজার ফাঁড়িতে গত ১১ অক্টোবর নির্যাতনে মারা যান নগরের আখালিয়া এলাকার রায়হান আহমদ। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ফাঁড়ি থেকে ১০ হাজার টাকা দাবি করে রায়হানের মায়ের কাছে ফোন দেওয়া হয়েছিল। টাকা নিয়ে গেলেও রায়হানকে আর জীবিত ফিরে পায়নি পরিবার।
কেবল টাকার জন্য নয়, রায়হানকে হত্যার পেছনে রয়েছে অন্য কোনো কারণ- এমন ধারণা নিহত রায়হানের মা সালমা বেগমের। তিনি বলেন, শুধু টাকার জন্য নয়, রায়হানকে হত্যার পেছনে বড় কোনো কারণ আছে নিশ্চয়। নইলে এভাবে কেউ মারে? কী কষ্ট দিয়ে মারা হয়েছে রায়হানকে! আমি তো মা, কী করে সই, আমি তো ভাবতেই পারছি না…।
হত্যার পর রায়হানের লাশ পুলিশ বেওয়ারিশ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বলেও অভিযোগ সালমা বেগমের। তিনি বলেন, পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের পর রায়হানের পরনের শার্ট-প্যান্ট পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। মর্গে লাশের গায়ে যে শার্ট-প্যান্ট ছিল এগুলো রায়হানের নয়। মর্গে ছেলের লাশ দেখে এ ব্যাপারটি তিনিই প্রথম চিৎকার করে বলেছিলেন বলে দাবি করেন।
সালমা বেগম বলেন, মারতে মারতে ফাঁড়িতেই মেরে ফেলা হয়েছে রায়হানকে। পোশাক বদল করে হয়তো বেওয়ারিশ লাশ বানানোর কোনো কারসাজি থাকতে পারে। ফাঁড়িতেই যখন ঘটনা ঘটেছে, তখন তো কোনো পাবলিক জড়িত নয়। সবাই ফাঁড়ির পুলিশ। তাদের কয়েকজনকে আমি মর্গে দেখে গালিও দিয়েছি। বলেছি, আমার ছেলের পরনে এই শার্ট-প্যান্ট বদল করে লাশটা বেওয়ারিশ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এগুলো আমি রেখে দিয়েছি। তদন্ত করলে এখান থেকে অনেক কিছু বের হতে পারে।
হত্যার পর ঘটনা ধামাচাপা দিতে রায়হানকে ছিনতাইকারী দাবি করে পুলিশ অপপ্রচার চালিয়েছে জানিয়ে সালমা বেগম বলেন, পুলিশ ঘটনা ধামাচাপা দিতে এসব মিথ্যা বলেছে। পুলিশকে আমরা রক্ষক বলি। রক্ষকরাই ভক্ষণ করল আমার রায়হানকে। ময়নাতদন্তে রায়হানের দেহে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন চিকিৎসকরা। তার হাতের নকও উপড়ানো ছিল।
রায়হানকে নির্যাতনের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে আলোচিত হচ্ছে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বহিষ্কৃত ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়ার নাম। তবে সালমা বেগম মনে করেন, শুধু আকবর নয়, এই ঘটনার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত আছে। আকবরসহ কয়েকজন অভিযুক্ত শনাক্ত হওয়ার পরও গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর পরিদর্শক মহিদুল ইসলাম বলেন, আকবরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। রিমান্ডে আনা টিটুর কাছ থেকে তথ্য বের করার চেষ্টা চলছে। হত্যার কারণ শিগগিরই বের করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নগরীর রিকাবিবাজার স্টেডিয়াম মার্কেটে এক চিকিৎসকের চেম্বারে কাজ করতেন রায়হান। রাতে কাজ শেষে ফেরার পথে তাকে ফাঁড়িতে নিয়ে যায় পুলিশ। হত্যাকা-ের পর ১২ অক্টোবর রাতে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে হেফাজতে মৃত্যু আইনে সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন রায়হানের স্ত্রী।
এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হলে রায়হানকে ফাঁড়িতে এনে নির্যাতনের প্রাথমিক প্রমাণ পায় কমিটি। এ কমিটির সুপারিশে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটুচন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত এবং এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজীব হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়। এ মামলায় গত মঙ্গলবার টিটুচন্দ্র দাসকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে পিবিআই। প্রধান অভিযুক্ত আকবর ১২ অক্টোবর থেকে পলাতক।
এ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে ওঠে সিলেটে। সমালোচনার মুখে পড়ে সিলেট মহানগর পুলিশ। সমালোচনার মুখে গত বুধবার মহানগর পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়াকে বদলি করা।
Leave a Reply