পয়েন্ট টুটু বোরের অত্যাধুনিক পিস্তল। নাম ‘উজি’। দেশে দেশে অস্ত্রটি ব্যবহার হয়, সাধারণত সামরিক বাহিনীতে। ইসরায়েলে তৈরি সেমি-অটোমেটিক এ পিস্তলে রয়েছে প্রতিটি ২০ রাউন্ডের করে দুটো ম্যাগাজিন। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীতেও এত বেশি গুলি ধারণক্ষমতার পিস্তল নেই। এখানে ব্যবহৃ.ত পিস্তলগুলোর ম্যাগাজিনের ধারণক্ষমতা হয়ে থাকে সর্বোচ্চ ১৫ রাউন্ডের। এর পরও এ দেশে আমদানি করা হয়েছে অত্যাধুনিক এ পিস্তলটি। তবে তা কোনো বাহিনীর জন্য আনা হয়নি এবং আনার পন্থাটিও বৈধ নয়। সম্প্রতি জানা গেছে, ৯১টি ‘উজি’ পিস্তল মিথ্যা ঘোষণায় জার্মানি হয়ে এ দেশে এসেছে। শুধু তাই নয়, এসব অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র পৌঁছে গেছে মাদককারবারিদের হাতেও। বিষয়টি শুধু নিরাপত্তা বাহিনীর জন্যই নয়, পুরো দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নেই উদ্বেগের।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গিদের হাতে অত্যাধুনিক এ অস্ত্রটি পৌঁছে গেলে দেশের যে কোথাও যে কোনো সময় ভয়াবহ এক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ইতোমধ্যে মাদককারবারিদের কব্জায় চলে গেছে এসব অস্ত্র। সঙ্গত কারণেই নিরাপত্তা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এক ধরনের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা; বিষয়টি রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে তাদের।
গত ২০ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের সামনে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বিদেশি মদ ও বিয়ারসহ মাদককারবারি মো. মিলান শরীফকে (৫৬) গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় তার গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া যায় আগ্নেয়াস্ত্রের একটি লাইসেন্স।
এর ভিত্তিতে পরে মিলান শরীফের বাসায় অভিযান চালিয়ে সন্ধান মেলে অত্যাধুনিক ‘উজি’ পিস্তলের, সঙ্গে ৪৪ রাউন্ড গুলিও। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে এ অস্ত্রটি খুব বেশি প্রচলিত। এর দুদিন পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয় মিলান শরীফের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তার লাইসেন্সে অস্ত্রের যে বিবরণ, তার সঙ্গে জব্দকৃত অস্ত্রটি না মেলায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে ডিবি পুলিশ। এরই ধারাবাহিকতায় আদালত নির্দেশ দেন এর তদন্তের। এর পর জিডির সূত্র ধরে তদন্তে নামে ডিবি।
লাইসেন্সে বর্ণিত অস্ত্রের সঙ্গে প্রাপ্ত অস্ত্রটির সাদৃশ্য না থাকায় ডিবি পুলিশ অস্ত্র ও লাইসেন্সের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞের কাছে অস্ত্রটি প্রেরণ করে। বিশেষজ্ঞের মতামতে বলা হয়, উজি পিস্তল সেমি অটোমেটেড হওয়ায় সেটি ক্রয়যোগ্য নয়। এটি ‘মিলিটারি গ্রেডে’র একটি অস্ত্র। বেলজিয়ামের আর্মড ফোর্স এবং ইসরায়েলের ডিফেন্স ফোর্সে অস্ত্রটির বহুল ব্যবহার রয়েছে। এটি এ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহৃত অস্ত্রের চেয়েও আধুনিক। উজির ম্যাগাজিন ২০ রাউন্ডের আর বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত পিস্তলে ম্যাগাজিনের ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৫ রাউন্ড। ওই বিশেষজ্ঞ আরও জানান, উজি পিস্তল আর উজি রাইফেল- এ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র। দুয়ের স্পেয়ার পার্টস, ওজন ও দৈর্ঘ্য ছাড়াও নানাবিধ পার্থক্য রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো উজি রাইফেলের ঘোষণা দিয়ে কাস্টমস থেকে উজি পিস্তলের চালান খালাস করে। অস্ত্র খালাসের ক্ষেত্রে কাস্টমসের ৭ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা না করে কীভাবে অস্ত্রের চালানটি ছাড়ের অনুমতি দিল, যেখানে রাইফেলের পরিবর্তে পিস্তল আনা হয়েছে?
বিশেষজ্ঞের মতামত প্রাপ্তির পর নড়েচড়ে বসে ডিবি পুলিশ। শুরু হয় তাদের উদ্বেগ। ফলে গভীরতর তদন্ত শুরু করে তারা। দেশে বর্তমানে ৮৪টি বৈধ অস্ত্র ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতেই রয়েছে ৩২টি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া দেশের মোট ১৪টি প্রতিষ্ঠান সরাসরি বিদেশ থেকে অস্ত্র আমদানি করতে পারে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে বিক্রি করে থাকে। এমন ১৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২টিই ঢাকাতে। এ পর্যন্ত ৫টি প্রতিষ্ঠান ৯১টি উজি পিস্তল এবং একটি প্রতিষ্ঠান ২০টি উজি রাইফেল আমদানি করেছে। এর মধ্যে ৪৯টি অস্ত্র ইতোমধ্যে বিক্রিও হয়ে গেছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- এমএইচ আর্মস কোং, মঈন আর্মস কোং, আহম্মদ হোসেন আর্মস কোং, মেসার্স তোফাজ্জল হোসেন, কে আহমদ আর্মস অ্যান্ড কোং এবং শফিকুল ইসরাম আর্মস অ্যান্ড কোং। ডিবি পুলিশের হাতে জব্দকৃত উজি পিস্তলটি এমএইচ আর্মসের। মঈন আর্মসই শুধু উজি রাইফেল আমদানি করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এমএইচ আর্মসের স্বত্বাধিকারী মোকারম হোসেন খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের সেক্রেটারি আপনাকে বুঝিয়ে বলবেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) গোলাম মোস্তফা রাসেল আমাদের সময়কে বলেন, অস্ত্রের বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। ইতোমধ্যে একটি প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পুলিশ সদর দপ্তর হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে ডিবি পুলিশ। গতকাল বুধবার পাঠানো ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘আমদানি নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ‘পয়েন্ট টুটু বোরের রাইফেল’ উল্লেখ থাকলেও অস্ত্রের ধরন সুস্পষ্ট নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা কাস্টমস হাউস ও জেলা প্রশাসনে কোনো অস্ত্র বিশেষজ্ঞ না থাকায় এবং আমদানির আগে বিশেষজ্ঞ মতামত না নেওয়ায় অস্ত্র ব্যবসায়ীরা উজি পিস্তলকে উজি রাইফেল ঘোষণা দিয়ে আমদানি, মজুদ ও বিক্রি করছে। বিশেষজ্ঞ মতামত থেকে প্রতীয়মান হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়া জনসাধারণের নিকট এ ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সেমি অটোমেটিক অস্ত্র আমদানি করে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করায় তা বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের হাতে চলে এসেছে। মাদক ব্যবসায়ীর মতো অপরাধীরা এ অস্ত্র জনসম্মুখে প্রদর্শনের মাধ্যমে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে মাদক ব্যবসা নির্বিঘœ করছে। এ ধরনের অস্ত্র জঙ্গিদের হাতে গেলে দেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- অস্ত্রের ক্যালিবারের পাশাপাশি ধরণ সুনির্দিষ্ট থাকা প্রয়োজন। পিস্তল অথবা রাইফেল উল্লেখ করলেও ম্যাগ্যাজিন ক্যাপাসিটি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। নিরাপত্তা বাহিনীর অস্ত্র বিশেষজ্ঞ যৌথ মতামতের ভিত্তিতে বৈধ অস্ত্র সংক্রান্ত আইন যুগোপযোগী করা। ইতোমধ্যে আমদানি ও বিক্রয় হওয়া এসব অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা প্রয়োজন। কাস্টমস থেকে অস্ত্রের চালান খালাসের ক্ষেত্রে অস্ত্র বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি ও পরিদর্শনের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। লাইসেন্স আবেদনকারীর সামাজিক মর্যাদা, পেশা ইত্যাদি বিষয় যাচাইয়ে আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
ডিবি পুলিশ কর্তৃক জব্দ করা ইসরায়েলি উজি পিস্তলের বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, যারা অস্ত্রের চালান খালাস করেছেন, তারা জানেন না কোনটা কোন গ্রেডের অস্ত্র। তাদের এ সংক্রান্ত কোনো প্রশিক্ষণও নেই। তিনি যোগ করেন, যারা এসব পণ্য ছাড় করেছেন, দেশের প্রতি তাদের কোনো আন্তরিকতা আছে কিনা সন্দেহ। এ ছাড়া দুর্নীতিও আছে। টাকা পয়সা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে এমনও দেখা যায়।
ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. মোয়াজ্জেম হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, এসব অস্ত্র পুলিশের কথা বলে আনা হয়। পরে পুলিশকে জানালে তারা তাদের অস্ত্র নয় বলে জানায়। অস্ত্রগুলো এখনো খালাস করা হয়নি। এগুলো আটক আছে। আমরা তদন্ত করছি। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কাস্টমস কমিশনার অস্ত্র খালাস হয়নি দাবি করলেও আমদানি করা ৯১টি অস্ত্রের মধ্যে ইতোমধ্যে ৪৯টি উজি পিস্তল যে বিক্রি হয়ে গেছে তা নিশ্চিত করেছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
Leave a Reply