গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবসহ ইন্টারনেট-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বিজ্ঞাপনসহ অন্যান্য যেসব লেনদেন হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণে সেসব থেকে রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছেন, আন্তর্জাতিক এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো উৎস কর বা ভ্যাট এবং শুল্ক না দেওয়ায় সরকার এবং দেশীয় গণমাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনার পরদিন সোমবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, ভ্যাট আদায়ে জটিলতা চিহ্নিত করে তা নিরসনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর আগে গত রোববার হাইকোর্ট ভ্যাট এবং শুল্ক আদায়ে কয়েক দফা ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবসহ ইন্টারনেটভিত্তিক প্লাটফর্ম ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। ফলে ক্ষুদ্র থেকে বড়-সব ধরনের উদ্যোক্তা বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য এখন ঝুঁকছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে। এই পেমেন্টগুলো কিভাবে হচ্ছে- সেই প্রশ্নও আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
জান্নাত সাথী নামের একজন পোশাক ডিজাইনার বলেছেন, তিনি ফেসবুকে কয়েকবার তার পণ্যের প্রচার করেন, সেজন্য অর্থ দিয়েছিলেন ক্রেডিড কার্ডের মাধ্যমে। কিন্তু ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এই অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে ভ্যাট বা উৎস কর সম্পর্কে কখনো তাকে কিছু জানায়নি।
তিনি বলেন, ‘আমার প্রোডাক্ট হচ্ছে শাড়ি। এর প্রোমশন ফেসবুকে কার্ডের মাধ্যমেই করি। কার্ডের মাধ্যমে ডলারে পেমেন্ট হয়। এর মধ্যে ভ্যাট বা কী আছে- সেটা বিস্তারিত আমাদের জানানো হয় না।’
একটি বেসরকারি বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে জানিয়েছেন, এখন বিজ্ঞাপন বাজারের ২০ শতাংশই গুগল, ফেসবুক ইউটিউবের মতো প্লাটফর্মগুলো নিয়ে যাচ্ছে এবং তা বেড়েই চলেছে। এই তথ্য তারা তাদের এক জরিপে পেয়েছেন। এই পরিস্থিতি তাদের শঙ্কায় ফেলেছে।
এ ধরনের প্লাটফর্মগুলোর কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের প্রশ্ন নিয়ে আড়াই বছর আগে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন আইনজীবী হুমায়ুন কবির। এ নিয়ে গবেষণা করে তিনি দেখেছেন, সামাজিক মাধ্যমগুলোর বিজ্ঞাপন নিয়ে ভ্যাট না দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর অব্যবস্থাপনা বড় সমস্যা। এ ছাড়া অ্যামাজনের মতো ইন্টারনেটভিত্তিক কেনাকাটার প্লাটফর্মগুলোর কাছ থেকেও ভ্যাট আদায় করা যাচ্ছে না।
এই প্লাটফর্মগুলোর বাংলাদেশে লেনদেনের বিষয়ে মনিটরিংয়ে ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে আইনজীবী হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বেশির ভাগই ইন্টারন্যাশনাল কার্ডের মাধ্যমে পেমেন্ট হচ্ছে। এটা ট্র্যাক করা ডিফিকাল্ট হয়ে যাচ্ছে। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পেমেন্ট হচ্ছে, কিন্তু এটার ডিটেলস জানার ক্ষেত্রে আমাদের যে ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি দরকার-তা নেই। মোবাইল কোম্পানিগুলো কিন্তু গুগল, ফেসবুককে অনেক টাকা পে করে থাকে প্রতিবছর। সেখানে কতটা ভ্যাট এবং শুল্ক আমরা পেয়েছি-এটাও বড় প্রশ্ন।’
তার রিট মামলার পর হাইকোর্ট সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দেয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশনা দেখার পর তিনি ভ্যাট আদায়ে জটিলতা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বক্তব্য হচ্ছে, এই প্লাটফর্মগুলোর ঢাকায় কোন অফিস না থাকায় ভ্যাট বা শুল্ক আদায় করা যাচ্ছে না। এসব ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময় এই প্লাটফর্মগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছে।
এ ব্যাপারে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছেন, ‘আমাদের দেশের রেডিও, টেলিভিশন বা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হলে ভ্যাট দিতে হয়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, এই যে সামাজিক মাধ্যম- গুগল কিংবা ফেসবুক বা অন্যরা- এই যে প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে বিজ্ঞাপন নেয়, তারা ভ্যাট প্রদান করে না। এটা আমাদের আইনের বিরোধী। যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভ্যাট না দেয় তাহলে আমাদের গণমাধ্যমের থেকে তারা বাড়তি সুযোগ নিচ্ছে।’
এ বিষয়ে ফেসবুকের পলিসি কমিউনিকেশন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেছে, আদালতের নির্দেশনার ব্যাপারে তারা ওয়াকিবহাল আছে। আর বিস্তারিত কিছু তারা বলেনি।
তবে গুগলসহ অন্যান্য মাধ্যমগুলো বিষয়টিতে ঢাকায় সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। তারা ভ্যাট দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত দুর্বলতার কথা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছে বলে জানা গেছে।
কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশের আইনে কোন দুর্বলতা নেই। এসব প্লাটফর্মকে নিবন্ধনের আওতায় আনাসহ তাদেরকে বিভিন্ন নিয়মের মধ্যে ফেলতে বিধিমালা তৈরি করা হচ্ছে।
Leave a Reply