একনায়কত্ব ও স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত আরব যুবকদের অর্থনৈতিক মুক্তি, গণতন্ত্র ও নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার পথে স্বপ্ন দেখানো শুরু করে ‘আরব বসন্ত’ নামের এক আন্দোলন।
২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর জন্ম নেয়া এই আন্দোলন ২০১১ সালের শুরুতে ব্যাপক আকার ধারণ করে তিউনিসিয়ায়।
সেখান থেকে একের পর এক কর্তৃত্ববাদী শাসনের আরব দেশগুলোতে বিস্তার লাভ করে। আরব যুবকদের মনে এ আন্দোলন নিয়ে আসে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সচেতনতা ও গণতন্ত্রের স্পৃহা। এএফপি।
ক্ষমতাকে পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলা একনায়কদের মনে ধরিয়ে দেয় মসনদ হারানোর শঙ্কা। প্রথমেই তিউনিসিয়ার ২৩ বছরের স্বৈরশাসক জায়নুল আবেদিন বেন আলীর মসনদ কেড়ে নেয় আরব বসন্ত। একাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর একপর্যায়ে স্বৈরশাসকদের দমন-পীড়নে স্তিমিতও হয়ে আসে আরব বসন্তের ঢেউয়ের শক্তি।
কোমায় চলে যায় প্রতাপশালী এই আন্দোলন। কিন্তু এক দশক পর পেছনে ফিরে তাকালে কী মূল্যায়ন হবে আন্দোলনটির? এটি কি মরে গেছে, নাকি নতুন করে ডালপালা গজাচ্ছে?
করোনায় কাবু ২০২০ সালে আরব বিশ্বের কিছু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আন্দোলনের দিকে তাকালে মনে হয়- না, মরে যায়নি আরব বসন্ত। এখনও কিছু দেশে এর উপস্থিতি আছে।
যেভাবে সূত্রপাত…
তিউনিসিয়ার সদ্য স্নাতক যুবক মোহামেদ বুয়াজিজি কোনো চাকরি না পেয়ে সিদি বাওজিদ শহরের স্থানীয় বাজারে ফল বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। ১৭ ডিসেম্বর, ২০১০ সকালে পৌরসভার এক নারী পুলিশ এসে ঘুষের জন্য বাগড়া দেন বুয়াজিজির ভ্যানের কাছে। কিন্তু তিনি সেটি দিতে রাজি না হওয়ায় বাজেয়াপ্ত করা হয় তার ভ্যান ও পণ্য।
অনেক অনুনয়-বিনয়েও কোনো কাজ হয়নি। উপায়ান্তর না দেখে সরকারি দফতরের সামনে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন তিনি। ১৭ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৪ জানুয়ারি, ২০১১ মারা যান বুয়াজিজি। তার পরই তিউনিসিয়ায় শুরু হয় স্বৈরশাসক বেন আলীবিরোধী আন্দোলন।
একপর্যায়ে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এটি। মিসর ও সিরিয়াসহ কয়েকটি দেশে ভালো অবস্থান পেলেও শেষ পর্যন্ত স্বৈরশাসকদের দমন-পীড়নে স্তিমিত হয়ে পড়ে আরব বসন্ত।
এক দশক পরও অনুপ্রেরণা জোগায়…
বর্তমানে আলজেরিয়া, ইরাক, সুদান ও লেবাননে চলছে আরব বসন্তে অনুপ্রাণিত আন্দোলন। ইরানেও অর্থনৈতিক মন্দা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির দাবিতে একাধিকবার আন্দোলন দেখা গেছে। তবে কর্তৃপক্ষ সেগুলো দমনে সফল হয়।
আলজেরিয়ার মানুষ ২০১১ সালে খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্যের সমস্যায় জর্জরিত অবস্থায় আরব বসন্তের আন্দোলনে উজ্জীবিত হয়। এটি তাদের মধ্যে এমন প্রভাব তৈরি করে যে, ১৯৯২ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত সময়ের গৃহযুদ্ধের ভোগান্তিও তারা ভুলে যায়।
গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি যখন প্রেসিডেন্ট আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকা ৫ম বারের মতো নির্বাচনের পরিকল্পনা করেন, তখন বিভিন্ন শহরে মানুষ বিক্ষোভে নেমে পড়ে। ৩৩ বছর বয়সী আন্দোলনকারী জাকি হান্নাচে বলেন, ‘আমরা আরব বসন্ত থেকে শিক্ষা পেয়েছি।’ ২০০৩ সালে আমেরিকার হামলার মুখে পড়ে ইরাক।
দেশটির সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী আলী আবদুল খালেক বলেন, ‘আরব বসন্তের উত্থানকে আমরা নিজেদের দেশে গণতন্ত্র উদ্ধারের সুযোগ হিসেবে দেখছি। শক্তির মুখে একটি বাজে প্রশাসন থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি।’
৩৭ বছর বয়সী সুদানি অধিকারকর্মী মোহাম্মাদ আল-ওমার বলেন, ‘২০১১ সালের আরব বসন্তের আবির্ভাব আমাদের দেশে বিপ্লবী স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিয়েছে। তখন থেকে যুবক চাপ-প্রয়োগকারী গোষ্ঠীগুলো ছোট ও বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদের জন্য সংগঠিত হতে থাকে।’
১৯৯৮ সাল থেকে লেবাননে রাজনৈতিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন অধিকারকর্মী ও অ্যাডভোকেসি বিশেষজ্ঞ ইমাদ বাজ্জি। তিনি বলেন, ‘আরব বসন্ত তার স্বপ্নকে এগিয়ে নেয়ার রসদ জুগিয়েছে। আমাদের আশা দেখিয়েছে।’
সফলতা কেবল তিউনিসিয়ায়…
আরব বসন্তের জন্মভূমি হিসেবে আন্দোলনটি একমাত্র তিউনিসিয়াতেই সফলতা পেয়েছে। বেন আলীকে মসনদ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। বুয়াজিজি গায়ে আগুন দেয়ার এক মাস পরেই বেন আলীকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। পরে নির্বাচিত সরকার ও গণতন্ত্র এসেছে।
কিন্তু মিসরে আশা জাগিয়েও সফল হয়নি আন্দোলন। হোসনি মোবারকের পতন হলেও নির্বাচিত মুরসি সরকারকে পরাজিত করে আরেক স্বৈরশাসক আবদেল ফাতাহ আল-সিসি এখন ক্ষমতায়।
ইয়েমেনে ২০১২ সালে আলী আবদেল্লাহ সালেহ আন্দোলনের কারণে ক্ষমতা ছাড়লেও ২০১৪ সাল থেকে দেশটিতে চলছে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও সৌদি জোটের হামলা। বাহরাইনে প্রতিবাদকারীদের জেল দিয়ে ক্ষান্ত করা হয়েছে। আর লিবিয়ায় স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন হলেও দেশটির কপালে জুটেছে যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলা।
সিরিয়ায় আরব বসন্ত থেকে উদ্ভূত গৃহযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অনেক, হচ্ছে এখনও।
প্রথম স্মার্টফোন বিপ্লব, ফেক নিউজে ক্ষয়ের শুরু…
আরব বসন্তকে দেখা হয় প্রথম স্মার্টফোন বিপ্লব হিসেবে। আরবের বিভিন্ন দেশের তরুণরা স্মার্টফোন ব্যবহারে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং জড়ো হয়। ব্লগার হামাদি কালাউটচা বলেন, ‘আরব বসন্তের আন্দোলনে ফেসবুকের ভূমিকা ছিল বড় প্রভাবক।
কারণ মিডিয়াকে পাশ কাটিয়ে এর মাধ্যমে স্বৈরশাসকের নাকের ডগায় বসে তথ্য প্রকাশ করা যেত।’ তবে একই সঙ্গে অনলাইনে বিভিন্ন গুজব ও ভুয়া প্রচারণা আন্দোলনটিকে দুর্বলও করে দেয়।
সাবেক অধিকার কর্মী ও উদ্যোক্তা হাউদা আনাউয়ার বলেন, ‘গুজবের কারণে ভীতি তৈরি হয় ও স্প্রিহায় ভাটা পড়ে। মেয়েদেরকে ধর্ষণের গুজব তুলে পালিয়ে যেতে বলা হয়।’ সাংবাদিক ও গবেষক হাকিম বেলতিফা বলেন, ‘ফেক নিউজ ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে আন্দোলনটি ধূসর হয়।’
বিভিন্ন দেশে আন্দোলনটিকে দুর্বল করার জন্য সরকারের পক্ষে গুজব, ভুয়া খবর, সন্দেহ-অবিশ্বাস ও নানা অসত্য বক্তব্য তুলে ধরা হয়। রাষ্ট্রীয় মিডিয়াগুলোও জনগণকে অন্ধকারে রাখে। ইন্টারনেটের গণতান্ত্রিক শক্তি রুখে দেয়ার জন্য এর অধিক রাজনৈতিক ব্যবহারের কারণে ইন্টারনেটের শক্তি ক্ষয় হয় বলে মনে করেন গবেষক রোমেইন লেকোমটি।
Leave a Reply