জীবনে প্রথমবার জুয়ায় হারার পর আর সেই নেশা থেকে বেরোতে পারেননি বছর সাতাশের যুবক শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া। এক সময় সব হারিয়ে বড় দায়দেনার চাপে পড়েন। টাকা জোগাতে নামেন প্রতারণায়। বিদেশি বড় জাহাজে চাকরি দেওয়ার আশ্বাসে চার বছর ধরে বেকার যুবকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। প্রতারিতদের চাপ গিয়ে পড়ে শাহাদাতের পরিবারের ওপর। নিরুপায় বৃদ্ধ বাবা তার পেনশন ও জমি বিক্রির ৩০ লাখে পরিশোধ করেন লোকজনের টাকা। তাতেও অনুশোচনা আসেনি শাহাদাতের মধ্যে, বরং দিন দিন তার প্রতারণা আর দেনার দায় দুটোই বাড়তে থাকে। সমানে বাড়ে জুয়ার নেশাও। গত সোমবার রাতে কোতোয়ালি থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। সেই খবর পেয়ে গতকাল বিকাল পর্যন্ত ১৯ পাওনাদার থানায় হাজির হন।
জানা যায়, সর্বশেষ ওশান প্যাসিফিক শিপিং নামের একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ১৯ যুবকের কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়েছিলেন শাহাদাত। দেশ থেকে তাদের সাইন আউট করার জন্য ব্যবহার হয়েছিল কম্পাস শিপিং সার্ভিসেস নামের একটি শিপিং এজেন্সির মাধ্যম। গত সোমবার প্রতারিত যুযকরা নিউমার্কেটের কম্পাস শিপিংয়ের কার্যালয়ে এসে তাদের সাইন আউটের
বিষয়টি জানতে চান। তখনই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা প্রথমবারের মতো জানতে পারেন, তাদের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা চলছে। প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা দ্রুত কোতোয়ালি থানা পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করি। পুলিশ মামলা করতে বললে আমরা মামলাও করি। এর পর কৌশলে শাহাদাতকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
কী পরিমাণ টাকা তিনি লোকজনের কাছ থেকে নিয়েছেন তা আর মনে নেই শাহাদাতের। তবে ভোক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, গত ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত তার মিডল্যান্ড ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা জমা ছিল। গতকাল ওই হিসাব তদন্ত করে দেখা যায়, কোনো টাকা নেই। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শাহাদাত পুলিশকে জানান, মূলত আইপিএলকে ঘিরে জুয়া, অনলাইন জুয়া আর প্রতারণা করে মানুষের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎই তার জীবনের প্রধান দুটি কাজ!
এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন আমাদের সময়কে বলেন, ‘শাহাদাত এতই ধূর্ত যে, প্রতি মুহূর্তে নিজের মতো পরিকল্পনা সাজিয়ে মিথ্যা কথা বলেন। পুলিশকে তিনি বারবার ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। চাকরিপ্রার্থী যুবকদেরও এভাবে সুকৌশলে বশীভূত করেছেন। ছেলেরা কোনোরকম যাচাই-বাছাই না করেই এ ধরনের লোকজনকে টাকা দিয়ে দিচ্ছে। মিথ্যা তথ্যে বিভ্রান্ত হয়ে তারা এসব লোকের খপ্পরে পড়ছে।’
মিরসরাই থেকে আসা ভুক্তভোগী যুবক ওমর ফারুক (২১) গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘শাহাদাত হোসেন আমার কাছ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়েছেন। অন্য ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সর্বনিম্ন ৬০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন জাহাজে চাকরি দেওয়ার কথা বলে। তবে তিনি কখনো কাউকে চাকরি দিতে পারেননি।’
শাহাদাত হোসেনের বাড়ি কুমিল্লার রাজবল্লবপুর হলেও নগরীর হালিশহর কে ব্লকে সপরিবারে বসবাস করেন। তিনি ২০১০ সালে এসএসসি ও ২০১২ সালে এইচএসসি পাসের পর চট্টগ্রাম কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। পুলিশকে শাহাদাত জানান, দু’বছর পড়ার পর অনার্স শেষ না করেই তিনি নগরীর সল্টগোলা এলাকায় অবস্থিত ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৫ সালে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। এর পর তিনি কবির স্টিল রি-রোলিং মিলের দুটি জাহাজে এবং বসুন্ধরা গ্রুপের একটি জাহাজে ইঞ্জিন ওয়াচ রেটিং পদে কাজ করেন। মূলত তখনই তার জাহাজে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার মাধ্যমে নগদ টাকা আদায়ের বুদ্ধি মাথায় আসে।
একাধিক ভুক্তভোগী জানান, শাহাদাত নগদ টাকা নিতেন আর সমপরিমাণ টাকার চেক দিতেন। তবে প্রতিটি চেকেই তারিখ থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে কাটাছেঁড়া করতেন। একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, চেকগুলো যাতে পাস হওয়া না হওয়ার পর্যায়েই না যায় সে জন্য শাহাদাত চেকের নিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়া করতেন। কারণ কাটাছেঁড়া করা চেক ব্যাংক গ্রহণ করে না।
এদিকে ছেলে গ্রেপ্তার হওয়ার খবর শুনে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কোতোয়ালি থানায় আসেন শাহাদাতের বাবা অহিদুর রহমান ভূ্ইঁয়া। সাধারণ বীমা করপোরেশন থেকে ২০১০ সালে অবসর নেওয়া এই বৃদ্ধ আমাদের সময়কে বলেন, ‘দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে শাহাদাত সবার ছোট। এই ছেলের জন্য আমি আজ নিঃস্ব। প্রথমবার লোকজন টাকা পাবে শুনে গ্রামের এক কানি জমি বিক্রি করি। আর পেনশনের টাকাসহ সব মিলিয়ে ৩০ লাখ টাকা পাওনা পরিশোধ করি। এখন আমার কিছুই নেই। কিন্তু ছেলে আমার জুয়া ছাড়েনি। তার বিরুদ্ধে এর আগেও হালিশহর থানায় মামলা হয়েছে। আজ হলো কোতোয়ালি থানায়।’
আদালতের আদেশে গতকাল শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া দুটি ফেসবুক আইডি ব্যবহার করেন। এর একটি দেখান নিজের আইডি হিসেবে, অন্যটি বিদেশি কর্মকর্তার। এর পর দুটির মেসেঞ্জারে কথোপকথনের স্ক্রিনশট নিয়ে তা চাকরি প্রার্থীদের দেখানো হয়। সেখানে বিদেশি জাহাজে প্রচুর চাকরির পদ খালি আছে বলে জানানো হয়।
Leave a Reply