ট্রাইকোলজিস্ট বা চুল চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন মানুষের প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০টি চুল পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। এর বেশি হলে বা নতুন চুল না গজালে চিকিৎসকরা এটি এক ধরনের রোগ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বর্তমানে দেশের তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে অনেকের চুল পড়া সমস্যা বাড়ছে। এ সমস্যা সমাধানে অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালমিশ্রিত মানহীন কসমেটিক ব্যবহার করে অনেকে ভুল চিকিৎসারও শিকার হচ্ছেন। ফলে চুল পড়া রোধে আধুনিক চিকিৎসা যেমন পিআরপি থেরাপি, হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট, হেয়ার সার্জারি বা চুল প্রতিস্থাপন দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই এ বিষয়টি জানার আগ্রহ অনেক পাঠকের রয়েছে।
সাধারণত মানুষের চুল পড়ার কারণগুলোর মধ্যে ফিজিওলজিক্যাল ও প্যাথলজিক্যাল সমস্যা অন্যতম। এ ছাড়া মানুষের দেহে অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা ও ভিটামিন-ডির ঘাটতি হলে চুল পড়ে। দেশে এক শ্রেণির মানুষ আছে, যারা অতিরিক্ত ওজন কমাতে অনিয়ন্ত্রিত ডায়েট কন্ট্রোল করে। আবার আরেক শ্রেণি অর্থাৎ গরিব মানুষ আছে, যারা শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাদ্য পায় না। ফলে অ্যানিমিয়া হয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চুল পড়ে। এর বাইরে আরও কয়েক ধরনের চুল পড়া রোগ আছে। যেমন- অনেকের আকস্মিক চুল, ভ্রু ও দাড়ি কমে যায়। অনেকের চুল-দাড়ি, চোখের পাতা সব পড়ে যায়। এ দুটি লক্ষণকে বলা হয় অটোইমুইন ডিজিজ।
এ ছাড়া ভার্টিগো বা শ্বেতিরোগ, বোলাস ডিজিজ, কিডনি বিকল ও ক্যানসারের কারণে চুল পড়ে থাকে। অন্যান্য কারণ অবহেলা করার উপায় নেই। দীর্ঘক্ষণ ধুলাবালিযুক্ত পরিবেশে অবস্থান, নিয়মিত হেলমেট ব্যবহারে অতিরিক্ত মাথা ঘামা, নিদ্রাহীনতা, হেয়ার স্টাইলে পরিবর্তন অর্থাৎ চুল সোজা বা বাঁকা করতে নিম্নমানের জেল, ক্রিম, সিরাম জাতীয় কসমেটিক ব্যবহার, ইলেকট্রিক হিট, হিয়ার রিবন্ডিং ও কালার করা ইত্যাদি চুল পড়ার জন্য দায়ী। এর বাইরে বংশগত কারণ ও বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দায়ী।
পরিবেশগত ও জিনগত কারণে চুল পড়ার পাশাপাশি মানুষের শরীরে টেস্টস্টোরেন নামক এক ধরনের হরমোন আছে। যে উপাদানটি বাংলাদেশের মানুষের শরীরে বেশি দেখা যায়। প্রকৃতির নিয়মে এটি শরীরে মধ্যে ভেঙে ডিএইচটি বা ড্রাই-হাইড্রো টেস্টোস্টেরেন তৈরি করে। বংশত কারণে যাদের শরীরে বেশিমাত্রায় ডিএইচটি উৎপন্ন হয়, তাদের চুলও বেশি পড়ে। ডিএইচটি মূলত মাথার চামড়ার রক্তনালির ভেতরে জমা হয়ে রক্ত (খাদ্য) খেয়ে ফেলে। ফলে কিছুদিন পর মাথার অনেক জায়গায় চুল গজানো কমে যায় এবং আগের চুলগুলো পুষ্টিহীন হয়ে পড়ে।
আমরা যদি চুল পড়ার ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ের দিকে লক্ষ্য করি, তা হলে বংশগত টাক পড়ার প্রবণতায় ছেলেদের চুল পড়ার হার বেশি। কারণ নারীর তুলনায় পুরুষের হরমোনাল বিষয়, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে বেশি পরিবর্তন হয়। সমীক্ষা করে দেখা গেছে, শুধু সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চুলের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর মধ্যে শতকরা ৭০ থেকে ৭৫ জনই ছেলে। প্রতিদিন সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের বহির্বিভাগে গড়ে ৩০ জনের মতো রোগী চুলের সমস্যা নিয়ে আসছেন। এ হিসাবে বছরে ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ চুলের চিকিৎসা নিতে আসছে। এদের মধ্যে ২০-২৫ শতাংশেরই ইনজেকশন নেওয়া বা ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হয়
চুল পড়ার আধুনিক চিকিৎসা : কারো বংশগত কারণে চুল পড়লে প্রাথমিক অবস্থায় রোধ করতে ও ফের চুল গজাতে সাহায্য করে- এমন কিছু ওষুধ, যেমন- ওয়েন্টমেন্ট (মলম) ও মুখে খাওয়ার ইনস্টোরয়েড, ডুটামেক্স জাতীয় ক্যাপসুল দেওয়া হয়। তাতে কাজ না হলে থেরাপির পরামর্শ দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা বা পিআরপি থেরাপি, মাইক্রোনিডিলিং থেরাপি অর্থাৎ মেশিনের সাহায্যে চুলের গোড়া শক্ত করার পদ্ধতি, স্টিমসেল থেরাপি (মাথার ভেতরে এক ধরনের ইনজেকশন) দেওয়া হয়। এছাড়া যাদের মাথা একেবারে টাক হয়ে গেছে, স্থায়ী সমাধানে তাদের হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের পরামর্শ দেওয়া হয়।
চুল পড়া প্রতিরোধে কিছু ঘরোয়া পরামর্শ : চুল পড়া প্রতিকারে প্রথম পরামর্শ হলো- ট্রান্সফ্যাট মিশ্রিত ফাস্টফুড জাতীয় খাদ্য না খাওয়া, নিয়মিত ঘুম ও পরিমিত খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা। পাশাপাশি চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রসাধনী পণ্য ব্যবহার, বিউটি পার্লার বা জেন্টস পার্লারে চুলে হিট দেওয়া ও সোজা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করা ও কিছু খাবার, যেমন- দেশি বাদাম, চীনাবাদম, কাঁচা ছোলা, মিষ্টিকুমড়ার বিচি খেলে চুল পড়া কমে। তবে এ বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া ভালো।
Leave a Reply