দখিনের খবর ডেস্ক ॥ প্রক্রিয়াগত কারনে আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের আগে টিকা প্রয়োগ করা যাবে না। পরিকল্পনার অভাবে হাতে টিকা পেয়েও এখন বসে থাকবে সরকার। কবে টিকা মানুষের শরীরে প্রয়োগ শুরু করবে, সেই দিনক্ষণ ঠিক করার অপেক্ষায় পার করতে হবে সময়। গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে টিকা গ্রহণের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘কবে টিকা প্রয়োগ শুরু হবে তার কোনো সময় এখনো ঠিক হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়েছি, তিনি সময় দিলেই দিনক্ষণ ঠিক করব।’ তবে একটি সূত্র জানায়, মূলত নিবন্ধনে দেরি হওয়ার কারণেই টিকা প্রয়োগে দেরি হবে। বিশেষত অ্যাপসে নিবন্ধনের মাধ্যমে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করায় ২৫ জানুয়ারির আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে আসবে না। সে কারণে চাইলেও টিকা দেওয়া শুরু করা যাবে না। গত বুধবার তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেছিলেন, ২৩ জানুয়ারি সুরক্ষা অ্যাপস চূড়ান্ত হবে। এখন টেস্টিং চলছে। ২৫ জানুয়ারি তা হস্তান্তর করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘টিকা আসে না কেন তা নিয়ে কত হুলুস্থুল অবস্থা গেল। হা-হুতাশের কমতি নেই। কিন্তু এখন টিকা হাতে পাওয়ার পরও আমাদের বসে থাকতে হচ্ছে পরিকল্পনার জন্য। এ ক্ষেত্রে আগাম প্রস্তুতি থাকলে এমনটা হয়তো হতো না। নিবন্ধনেও কেন এতে দেরি লাগবে, সেটাও বুঝতে পারছি না। এসব কাজে সময় লাগবে সেটা তো সবারই জানা ছিল। সে অনুসারেই তো প্রস্তুত থাকার কথা। আগেও নানা ধরনের অপ্রস্তুতির কারণেই সরকারের সমালোচনা শুনতে হয়েছিল।’ তিনি বলেন, টিকা হাতে পেয়েও দিতে দেরি করলে মানুষের মধ্যে সংশয়-সন্দেহ বেড়ে যেতে পারে। তবে বিষয়টিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা শাখার বড় ধরনের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, অধিদপ্তরের ব্যর্থতার দায়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে সরকারকে। কিন্তু এর দায় এখন শুধুই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর বর্তাবে। কারণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ধরেই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বিভিন্ন কর্মসূচি বিবেচনায় নিয়ে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল, ২০-২৫ জানুয়ারির মধ্যে টিকা দেশে এসে পৌঁছবে। সে অনুযায়ী টিকা ঠিকই ২১ জানুয়ারি দেশে এসেছে। এটা উপহারের, নাকি কেনা টিকা তা মুখ্য বিষয় নয়। একই প্রতিষ্ঠানের টিকাই এসেছে। পরিমাণেও কম নয়, ২০ লাখ টিকা দেওয়া যাবে ১০ লাখ মানুষকে, চাইলে ২০ লাখ মানুষকেও দেওয়া যেতে পারে। কেনা টিকা আসতে দেরি হলেও এই ২০ লাখ ডোজ টিকা দিতেও অনেক সময় লাগবে। ফলে আগে থেকেই পরিকল্পনা করতে পারলে টিকা দেশে এসে পৌঁছার দু-এক দিনের মধ্যেই পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করা যেত। এখন আবার যদি ২৫-২৬ জানুয়ারির অপেক্ষায় থাকতে হয়, তবে পাঁচ-ছয় দিন সময় নষ্ট হয়ে গেল অযথাই। সে ক্ষেত্রে আগে টিকা এনেও কোনো লাভ হলো না; কাজে খাটাতে পারল না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র সরাসরি দুষছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখাকে। একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওই শাখার নেতৃত্বে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা আগাম পরিকল্পনায় জোর দিলেও তাতে পাত্তা দিতে চাননি শাখার ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা। বরং তাঁরা নিজেদের মতো করেই চালাতে চান সব কিছু। বিশেষজ্ঞরাও কেউ কেউ এমন অভিযোগ করেছেন। পরিকল্পনা নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন পরিকল্পনা শাখার শীর্ষ কর্তারা এবং পরিকল্পনার বিষয়টি যাতে গণমাধ্যমে না যায় সে জন্য অধস্তন কর্মকর্তাদের সতর্ক করে রেখেছেন। ফলে সঠিক তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাঘাত ঘটছে গণমাধ্যমের। বিভ্রান্তিরও সুযোগ থাকছে। অধিদপ্তর করোনার টিকার বিষয়ে তথ্য জানানোর জন্য একটি মিডিয়া সেল করেছে, কিন্তু ওই সেলের একাধিক সদস্য বলেন, তাঁরা পরিকল্পনার প্রশ্নে কথা বলায় এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করছেন এবং ভয়ে আছেন। তাঁদেরই একজন গতকাল বলেন, ‘কেন যে আমাদের এখন টিকা হাতে নিয়ে বসে থাকতে হবে আর সমালোচনা শুনতে হবে, সেটার মানে খুঁজে পাই না আমরাও। কিন্তু প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলা যাবে না।’ গতকালও এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে নবগঠিত মিডিয়া সেলের প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টিকে আমরা পরিকল্পনার ঘাটতি হিসেবে দেখতে চাই না। আবার টিকা হাতে নিয়ে বসে থাকারও বিষয় নয়। বরং আমরা তাড়াহুড়া করতে চাই না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর সময়সূচির অক্ষোয় আছি আমরা। তিনি সময় দিলেই বাকি সব আমাদের ঠিক করা আছে।’ তিনি বলেন, ‘উপহারের টিকা যে এত আগে এসে যাবে, সেটার হয়তো আমাদের খুব একটা প্রস্তুতি ছিল না। এখনো প্রশিক্ষণ শেষ হয়নি। ৪২ হাজার কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ছাড়া পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টিকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তখনো আমাদেরকেই সবাই দুষবেন।’ উদ্বোধনী দিনে কুর্মিটোলা হাসপাতালে যে ২০-২৫ জনকে টিকা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে, সেই তালিকা তৈরি হয়েছে কি না জানতে চাইলে নাসিমা সুলতানা বলেন, সেটা প্রস্তুত করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে। অবশ্য টিকার প্রয়োগ শুরুর ক্ষেত্রে কিছুটা দেরি হওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘টিকা এসেছে ভালো কথা। এ ক্ষেত্রে আরেকটু পর্যবেক্ষণ করে তারপর সুষুম পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করা ভালো। না হলে কোনো ভুল হয়ে যেতে পারে। তাই বলব—আমাদের হা-হুতাশ করা ঠিক না।’
Leave a Reply