বিশেষ প্রতিনিধি ॥ একটা সময় কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালটা যেন খেজুরের রস ছাড়া জমতোই না। শীত ও খেজুরের রস যেনও ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে আবহমান প্রতিটি গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে। শীত মৌসুমে প্রত্যন্ত গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে চলতো খেজুর রসের হরেক রকমে পিঠা ফুলির মহোৎসব। খেজুর রস আহরণকারী গাছিদের পরিবারসহ পল্লীর প্রতিটি ঘরে রস পায়েস তৃপ্তিতে প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেতো। রান্না হতো ফিন্নি, পায়েস, রসের গুড় দিয়ে ভাঁপা পিঠা এবং গাঢ় রস দিয়ে তৈরি হতো মিঠাই, আর সেই মিঠাই দিয়ে শীতের সকালে বানানো হতো চিড়া মুড়ি খই। যার স্বাদ ও ঘ্রাণ ছিল ভিন্ন। সেই স্বাদের পায়েস-পিঠা শীতের সকালের মিষ্টি রৌদ্রে ঘরের আঙিনায় বা উঠানে কচি-কাচা ছেলে-মেয়েদের পিঠা-পায়েস খাওয়ার আসর এখন আর চোখে পড়ে না। খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় হারিয়ে যেতে বসছে গ্রামবাংলার রস-পায়েসের সেই ঐতিহ্য। নতুন প্রজম্মের কাছে এখন এসব কথা রূপকথার গল্পের মতো। কালের বিবর্তনে ক্রমান্বয়ে স্মৃতির পাতায় চলে যাচ্ছে পিঠা-পায়েসের খেজুর রসের আনন্দ-উৎসবের পায়েস। কারণ আগের মতো খেজুর গাছ এখন আর নেই। এক যুগ আগেও প্রায় প্রতিটি বাড়ির দরজায়, পুকুরের পাশে,বিভিন্ন ক্ষেতের আইল,রাস্তার পাশে, ধান ক্ষেতের দু‘ই কিনারে কিংবা খালের পাড়ে ছিল সারি-সারি অসংখ্য খেজুর গাছ। শীতের শুতেই এসব খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত সময় পার করত গাছিরা। শীতের কুয়াশা ঘেরা সকাল সূর্য উঁকি দেওয়ার আগেই গাছিদের কোমরে দড়িঁ, কাঁধে হাঁড়ি ভরা রস নিয়ে যাওয়ার মনোমগ্ধকর দৃশ্য গ্রামীণ বাংলা ছাড়া আর কোথাও হয়তো দেখাই যেত না। এ দৃশ্য যেন মনে করিয়ে দিতো রং তুলিতে আঁকা নিখুত শিল্পীর এক মনোরম চিত্রকর্মের কথা। আবার খেজুরের রসের পাটালি গুড়েরও বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে বাংলার ঘরে-ঘরে। এই গুড় দিয়ে হরেক রকম পিঠা বানাত গাঁয়ের বধটুরা। ভাপা, সিদ্ধপুল, মালপোয়, লালুয়া, রসের চিতইয়ের মতো বহু রকম রসের পিঠা। আর এই পিঠা ঘিরে শিশু-বিদ্ধার বসে থাকার দৃশ্য বাংলার এক পুরোর সংস্কৃতিরই অংশ। এইপ দৃশ্যকে কবি সুফিয়া কামাল যেভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন,- “পৌষ পর্বণে পিঠে খেতে বসে,খুশিতে বিষম খেয়ে। বড় উল্লাস বাড়িয়েছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।” কবির এ উক্তিতে এক যুগ আগের খেজুর রসের পায়েস-পিঠার কথা স্বরণ করিয়ে দিলেও আজ সেই খেজুর গাছ বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিক’লতার কারণে বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছের পাশাপাশি গাছি ও রসও বিলুপ্তি হতে চলছে। এর প্রধান কারণ ইটভাটিতে খেজুর গাছ পোড়ানো, জলাবদ্ধতায় গাছ মরে যাওয়া, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও নতুন-নতুন ঘর-বাড়ি তৈরি হওয়া খেজুর গাছ নিধন করায় ক্রমেই বিলুপ্তি হতে চলছে রস উপকরনের খেজুর গাছ। যার কারণে স্মৃতির আগচরে হারিয়ে যাচ্ছে পিঠা-পায়েসের মহোৎসব। পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার পল্লী অঞ্চল খেজুরবাড়ি, আকলম,কৃকাঠি, জলাবাড়ি,চিনাবুনিয়া, গণমান, গুয়ারেখা,বিশাল, দুর্গকাঠি, শশীদ,চিলতলা, ঝিলবাড়ি,বাটনাতলা, জুলুহার, রাখাতলা, রুদ্রপুর ও জৌসার, এলাকাগুলোতে দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমার পাশাপাশি রস সংগ্রহ করা গাছির সংখ্যাও কমে গেছে। বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছের রস। তার পরেও বাপ-দাদার পেশা দড়ে রাখার জন্য ছড়িয়ে-ছিড়িয়ে এখনও নেছারাবাদে খেজুর গাছ টিকেয়ে রেখে গাছিরা রস সংগ্রহ করছে।
Leave a Reply