বিনোদন ডেস্ক ॥ ‘যে কখনো হাল ছাড়ে না তাকে হারানো কঠিন। আমি কি ঠিক বলছি বন্ধুরা?’ ফেসবুকে এমন কথা বলেছিলেন বলিউড অভিনেতা অনুপম খের। তাঁর জীবনের গল্পটা এমনই, হাল ছেড়ে না দেওয়ার গল্প। আর যে গল্পে অবশ্যই তিনি জয়ী। আজ ৭ মার্চ সেই জয়ী মানুষটা ৬৬ বছরে পা দিলেন। ১৯৫৫ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অনুপম খের। ১৯৮১ সালে মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) গিয়েছিলেন তিনি। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮২ সালে হিন্দি সিনেমা আগমন দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তারপর থেকে কৌতুক, খল অভিনেতা, বিত্তশালী বাবা কিংবা রাজনীতিবিদ—কত বিচিত্র চরিত্রে দেখা গেছে এ অভিনেতাকে। টেকো মাথার লোকটা শুধু অভিনয়গুণ দিয়ে বারবার আলোচনায় এসেছেন। ৬৬, তবে এটা অনুপম খেরের কাছে একটি সংখ্যামাত্র। বয়সের সঙ্গে অনুপম খের কখনো প্রবীণ হয়ে যাননি, বরং নিয়মিত ব্যায়ামাগারে শরীরচর্চায় রীতিমতো ‘মডেল’ হিসেবে দেখা গেছে তাঁকে। আবার এমনও দেখা গেছে, ফিটনেসের জন্যও আলাদা করে তাঁকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুপম খেরের জিমের ছবি দেখলে তাক লেগে যেতে হয়। বর্ণাঢ্য জীবনযাপন তাঁর। এই বয়সেও ব্যস্ত মানুষটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সচল। নিয়মিত নিজের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার অ্যাকাউন্টে ছবি, ভিডিও পোস্ট করে নিজের সময় থেকে এগিয়ে থাকা তারুণ্যের প্রমাণ দেন। অনুপম খেরের অভিনয়জীবনের বয়স ৪০ বছর। এখন পর্যন্ত ৫১৫টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ক্যারিয়ারে অনেক ওঠানামাও দেখেছেন। কিন্তু আজও অভিনয় ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না তিনি। তবে তাঁর অভিনয়জীবনের শুরুটা নিদারুণ সংগ্রামের ছিল। সম্প্রতি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দুটি পুরোনো দুটি ছবি পোস্ট করেন। একটিতে সাদা–কালো ক্যানভাসে, তখন তিনি বছর ২৬-এর যুবক। অন্যটিতে সাদা পাতায় ইংরেজি হরফে লেখা ঠিকানা। ছবিগুলোর সঙ্গে অনুপম লিখেছেন, ‘ছবিতে কাজ করতে ১৯৮১ সালের ৩ জুন মুম্বাই শহরে এসেছিলাম। ওই বছরের ১৫ জুন রাজশ্রী প্রোডাকশনসের অফিসে আমার এই পোর্টফোলিওটা রেখে এসেছিলাম। যদি আমাকে কোনো চরিত্রের জন্য বেছে নেওয়া হয়, সেই আশায় অপেক্ষা করেছি। অর্থের অভাব ছিল, থাকার জায়গা ছিল না। এমনও অনেক রাত গেছে তাঁর, সমুদ্রের তীরে সৈকতের বালুতে, রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুমাতে হয়েছে তাঁকে। মায়ের থেকে মিথ্যা বলে ১০০ টাকা নিয়ে অডিশন দিতে গিয়েছিলেন অনুপম খের। আমার তখনো কোনো থাকার জায়গা ছিল না। তাই আমার ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার বন্ধু করণ রাজদানের ঠিকানাটা দিয়ে এসেছিলাম।’ পরবর্তী সময়ে রাজশ্রী প্রোডাকশনসের সঙ্গে বেশ কিছু কাজ করেন অনুপম। সেই কথা মনে করে এই অভিনেতা লিখেছেন, ‘শেষ ৪০ বছরে আমি ওদের সঙ্গে ৪টি ব্লকব্লাস্টার ছবি করেছি। আমার প্রথম দিককার ছবি “সারাংশ” (১৯৮৪)। এরপর “হাম আপকে হ্যায় কৌন” (১৯৯৪), “বিবাহ” (২০০৬), “প্রেম রতন ধন পায়ো” (২০১৫)। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, যখন রাজশ্রী প্রোডাকশনসের গুপ্তাজি ভালোবাসার প্রতীক ও স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আমাকে ছবিটি পাঠিয়েছিলেন…!’ আসলে অনুপম খেরের শুরুটা ছিল ঠিকানাবিহীন। নিজের আত্মজীবনীতেও এসব তুলে ধরেছেন। যেখানে জানা গেছে, অর্থের অভাব ছিল, থাকার জায়গা ছিল না। এমনও অনেক রাত গেছে তাঁর, সমুদ্রের তীরে সৈকতের বালুতে, রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুমাতে হয়েছে তাঁকে। মায়ের থেকে মিথ্যা বলে ১০০ টাকা নিয়ে অডিশন দিতে গিয়েছিলেন অনুপম খের। একেবারেই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ অনুপম খের। বাবা ছিলেন বন বিভাগের সাধারণ এক কেরানি। ইনস্টাগ্রামে নিজেই জীবনসংগ্রামের কথা তুলে ধরে তিনি লিখেছেন, ‘যখন খুব ছোট ছিলাম, দাদাকে জিজ্ঞাস করেছিলাম, আমরা এত গরিব। তবু কীভাবে এত সুখে আছি? তখন তিনি বলেছিলেন, “দারিদ্র্য আমাদের সবচেয়ে সস্তা বিলাসিতা।” আমার বাবা খুব আশাবাদী ছিলেন। পরীক্ষায় কখনো ৬০-এর মধ্যে ৫৯ পেলেও বাবা বলে গিয়েছেন, পরেরবার যেন আরও ভালো হয়। আর এটাই আমাকে অদম্য সাহস জোগায় জীবনের ব্যর্থতার সময়।’ আত্মজীবনীতে অনুপম খের লিখেছেন, ‘মঞ্চ আমার প্রথম প্রেম, খুব ভালোবাসতাম। সারাক্ষণ অভিনয়ের কথা ভাবতাম। একদিন চণ্ডীগড়ে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়, সেখানে বলা ছিল বিজ্ঞাপনে অভিনয়ের জন্য লোক দরকার। কিন্তু হাতে টাকা নেই। মায়ের থেকে পিকনিকের কথা বলে ১০০ রুপি নিয়ে অডিশন দিতে গেলাম। পরে অবশ্য মা জানতে পেরেও কিছু বলেননি, তিনি মেনে নিয়েছিলেন।’ চণ্ডীগড়ে অভিনয়ের ক্লাসে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন অনুপম খের। সেখানে তিনি দুই বছর শিক্ষকতাও করেছিলেন। এ তথ্য দিয়ে অনুপম খের লিখেছেন, ‘একদিন জানতে পারি, মুম্বাইয়ে একটি নাটকের স্কুল আছে। সেখানে আবেদন করলে আমাকে ডাকা হলো। দেওয়া হলো একটি ছোট্ট ঘর। কিন্তু কোনো টাকাপয়সা কিছুই দিল না। বেশির ভাগ দিন খিদে পেটে ঘুমাতে হতো। পকেটে টাকা থাকত না। এমনও হয়েছে, কখনো সাগরপাড়ের সৈকতে, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।’ কষ্টের এই সময়ের কথা বাবা-মাকে জানাতে চাননি অনুপম খের। তাই তিনি দাদাকে লিখে পাঠাতেন, ফিরতে চান তিনি। কিন্তু দাদা সায় দিলেন না। পাল্টা লিখলেন, ‘অনুপম, তুমি তো সেই মানুষ, যে পানির স্রোতে বেরিয়ে গেছ, সে আবার বৃষ্টির পানিতে ভয় পাচ্ছ! তুমি এভাবে কোনো দিনই বড় হতে পারবে না।’ কী করতে হবে বুঝে গেছেন অনুপম খের। বুঝে গেলেন মুম্বাই ছেড়ে কোনোভাবেই ফেরা যাবে না। এভাবে চলতে থাকে জীবন। এর মধ্যে একদিন সুযোগ চলে আসে। এ সময় মহেশ ভাটের একটি ছবিতে কাজ পান অনুপম খের। কিছু টাকা আর থাকার জায়গাও মেলে। কিন্তু সে সুখ স্থায়ী হয়নি। একদিন তিনি জানতে পারেন, ওই চরিত্রের জন্য অন্য কাউকে নেওয়া হয়েছে। চলে গেলেন মহেশ ভাটের কাছে। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, মহেশ ভাট তা স্বীকারও করেন। এবার ভেঙে পড়েন অনুপম খের। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখলেন, ‘আমি যেই মুহূর্তে মুম্বাই ছেড়ে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ই মহেশ ভাট বলেন, “তোমার মতো এই চরিত্রে কেউ এত ভালো অভিনয় করতে পারবে না। তাই তোমাকে ছাড়া এই ছবি বানাব না।” আমাকে ডাকা হলো এবং আমি জীবনে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করি মহেশ ভাটের হাত ধরে।’ নিজেই জানিয়েছেন, ৩০ টাকা দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু। এখন তিনি কয়েক শ কোটি টাকার মালিক। ৬৬ বছর বয়সী অনুপম খের জানিয়েছেন, প্রতিদিন কাজে যাওয়ার সময়ে নিজেকে বলেন অভিনয় সম্পর্কে কিছু জানেন না। তাঁর ভাষায়, ‘ওটাই একমাত্র উপায়। যদি নিজের জ্ঞান নিয়ে বড়াই করা শুরু করি, তাহলে নতুন আর কিছু শিখতে পারব না।’ এ বয়সে কোন বিষয়টি বেশি রোমাঞ্চিত করে অনুপম খেরকে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বেঁচে আছি, এটাই তো অনেক বড় কথা। আমি মনে করি, মানুষ চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। আমরা আমাদের মস্তিষ্কের মাত্র ১০ বা ২০ শতাংশ বা তার চেয়েও কম কাজে লাগাই। আপনার যদি ব্যর্থ হওয়ার ভয় না থাকে এবং সব সময় আশাবাদী হন, তাহলে আপনি অনেক কিছু করতে পারবেন। আমি তো অনেক কিছু করতে ভালোবাসি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব নেওয়ারও ব্যাপার থাকে।’ এতগুলো বছর ধরে নানা ছবি এবং চরিত্রের মাধ্যমে বিনোদন দিয়ে এসেছেন অনুপম। শেষ তাঁকে দেখা গেছে ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ ছবিতে। সামনে দেখা যাবে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এ। তবে তাঁকে বলিউডের দর্শক মনে রাখবে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ ‘লামহে’–এর মতো কিছু ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য।
Leave a Reply