দখিনের খবর ডেস্ক ॥ ভূমিকম্প ও সুনামির ক্ষেত্রে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু উপকূলবাসীর মধ্যে এসব দুর্যোগ সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। তাদের বেশির ভাগ এমন দুর্যোগের ধ্বংসাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সচেতন নয়। এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রস্তুতিও কম। বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে ২০১৩ সালে প্রকাশ করা একটি প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের (হটস্পট) একটি হিসেবে উল্লেখ করে। এ ছাড়া ২০১৬ সালে জেনেভাভিত্তিক জাতিসংঘ সংস্থা দ্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর ডিজাস্টার রিডাকশনের দেওয়া তথ্যেও বিশ্বে বন্যার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ প্রথম, সুনামির ঝুঁকিতে তৃতীয় এবং ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে ষষ্ঠ স্থানে বলে উল্লেখ করা হয়। ওই বছরই ‘নেচার জিওসায়েন্স’ সাময়িকীতে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে বড় ধরনের ভূমিকম্পঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে সতর্ক করেন গবেষকেরা। উপকূলীয় জেলা বরগুনার ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) দলনেতা জাকির হোসেন বলেন, উপকূলের ৯০ শতাংশ মানুষের সুনামি সম্পর্কে ধারণা নেই। যাদের ঘরে টেলিভিশন আছে, তারা কেউ কেউ ছবি দেখে এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা পেয়েছে। কিন্তু এ সংখ্যা খুব নগণ্য। উপকূলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও কৃষিকাজে জড়িত লোকজনকে ভবিষ্যতে এ দুর্যোগের বিপদ থেকে বাঁচাতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। জাকির হোসেন আরও বলেন, সুনামি ও ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল। সিপিপি এ ঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কারণ, উপকূলে সিপিপির ৫৫ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন। সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সুনামিকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিবার ও সমাজভিত্তিক প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করতে হবে। স্থানীয় দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত অংশের টেকটোনিক প্লেটের ফাটল বরাবর একটি ভূমিকম্পে সৃষ্টি সুনামি প্রায় তিন ঘণ্টা পর উপকূলে আছড়ে পড়েছিল। ফাটলটি এখনো সক্রিয় আছে। ভূমিকম্প থেকে সুনামি সৃষ্টি হলে উপকূলের ৭১০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় তা প্রায় ৪ মিটার (১৩ ফুট) উচ্চতায় আঘাত হানতে পারে। তা হলে বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, খুলনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চল বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে বলে অভিমত তাঁদের। বিশেষজ্ঞরা জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলের অংশবিশেষে কিছু পাহাড় রয়েছে। এসব পাহাড় প্রাকৃতিকভাবে সুনামির তীব্রতা রোধে ঢাল হিসেবে কাজ করতে পারবে। কিন্তু বরিশাল ও খুলনা উপকূলের সম্পূর্ণ অংশই অরক্ষিত। এখানকার উপকূলজুড়ে এ রকম প্রাকৃতিক ঢাল নেই, যা সুনামি থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষায় কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের একদল গবেষকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে যে ফল্ট লাইনের ভূমিকম্পে সৃষ্ট সুনামিতে ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল, সেই একই ফল্ট লাইনে নতুন করে ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এখানে ৪০০ বছর ধরে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, যা যেকোনো সময় রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার মতো প্রচণ্ড শক্তিশালী ভূমিকম্প তৈরি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের ১৪ কোটি মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ‘নেচার জিওসায়েন্স’ সাময়িকীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখনই বাংলাদেশ বড় ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে, এমন কথা বলা না গেলেও দুটি গতিশীল প্লেট পরস্পরের ওপর চেপে বসতে থাকায় সেখানে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। এদিকে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির প্রধান কার্যালয় সূত্র জানায়, সরকার এরই মধ্যে সুনামিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এ-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করছে। ২০১১ সালে দুবার ও ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তিন দফায় সুনামি সতর্কতার অংশ হিসেবে মহড়া পরিচালনা করা হয়েছে। মহড়া থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করে প্রস্তুতিতে কী ধরনের ঘাটতি আছে, তা খতিয়ে দেখা হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, সুনামি সতর্কসংকেত প্রচারব্যবস্থার জন্য সক্ষমতা বাড়াতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয় ওই নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সুনামিবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিন দিনের এক মহড়া চালানো হয়। পরে আর্থিক সংকটে পাইলট প্রকল্প এগোয়নি। সিপিপির কক্সবাজার জেলার উপপরিচালক হাফেজ আহম্মেদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, ভূমিকম্প ও বজ্রপাত বিষয়ে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। এ জন্য শিক্ষার্থী পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে ২০১৭ সালে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও মহড়া প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়েছিল। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-বনায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির বলেন, ‘সুনামির ভয়াবহতা থেকে শ্বাসমূলীয় বন আমাদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম। কারণ, এটা ঝোড়ো বাতাস ও উঁচু জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে সক্ষম। এ জন্য উপকূলের চরগুলোতে বেশি করে শ্বাসমূলীয় বনায়ন দরকার।’ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও সিপিপির পরিচালক (প্রশাসন) আহমাদুল হক বলেন, ‘সুনামি, ভূমিকম্প ও নতুন দুর্যোগ বজ্রপাতের বিষয়ে এরই মধ্যে নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। এ বিষয়ে বিদ্যালয় পর্যায়ে সচেতনতার জন্য প্রতিটি উপজেলার একটি করে বিদ্যালয়ে মহড়া ও প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হবে। করোনার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ। বিদ্যালয় খুললেই আমাদের এ কর্মসূচি শুরু হবে। এ জন্য আমাদের তহবিল সংকট নেই।’
Leave a Reply