দখিনের খবর ডেস্ক ॥ শ্রেণিকক্ষে পরীক্ষা নির্ভরতা কমাতে কারিকুলাম যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয় সরকার। লক্ষ্য ছিল ২০২১ সাল থেকে ধাপে ধাপে নতুন কারিকুলামে বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু করোনার কারণে এক বছর পিছিয়ে আগামী ২০২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিকে ১ম, ২য় এবং মাধ্যমিকে ৬ষ্ঠ, ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নতুন কারিকুলামে বই তুলে দেওয়া হবে। সেজন্য জোরেশোরে কাজ করছে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কিন্তু নতুন কারিকুলাম তৈরি করতে গিয়ে বিদেশি সংস্থা ও এনজিওকে বেশি প্রাধান্য, অতিমাত্রায় লার্নিং এডুকেশন (অভিজ্ঞতা ভিত্তিক) করায় কারিকুলাম কমিটির ওপর চরম ক্ষিপ্ত হয়েছে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা। এ নিয়ে এনসিটিবির ভেতরে চলছে চরম দ্বন্দ্ব। এর মধ্যে কারিকুলামের সঙ্গে যুক্তদের তালিকা চেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব। আর গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অপেক্ষায় আছে ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটির (এনসিসি) বৈঠকের অপেক্ষায়। সেখানে পুরো কারিকুলাম আটকে দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। অভিযোগ উঠেছে, এনসিটিবি ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশীয় কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে নতুন কারিকুলাম তৈরি করা হচ্ছে। গত তিন বছর ধরে দেশের বাস্তবতা যাচাই ও চাহিদা বিবেচনা করে এনসিটিবির বিশেষজ্ঞদের তৈরি করা যোগ্যতা ভিত্তিক শিখনফল (লার্নিং আউট কাম) বাদ দিয়ে অতিমাত্রায় অভিজ্ঞতা ভিত্তিক জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে, যা বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে যায় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এনসিটিবির বিভিন্ন কর্মশালায় প্রস্তাবিত কারিকুলাম এখনই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে একাধিক বিশেষজ্ঞ মতামত দেন। তারা বলেন, পশ্চিমা দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখনই অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম (এক্সপিরিয়েন্স লার্নিং) চালু হলে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের পক্ষে আয়ত্ব করা সম্ভব হবে না। এ কারিকুলাম চালু হলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আরও বেশি কোচিং এবং সহায়ক বই নির্ভর হয়ে পড়বে। প্রস্তাবিত প্রাক-প্রাথমিক স্তরের একটি বইয়ে চারটি ধর্মের বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। আর ইসলাম শিক্ষা বইয়ে যোগ্যতার গল্প বলা হয়েছে। এর ফলে সারা দেশে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর রূপরেখায় কারিগরি শিক্ষা যুক্তই করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এসব বিষয় কারিকুলামে যুক্ত না করার জন্য এনসিটিবিতে বেশ কয়েকজন ওয়াকআউট করেছেন (মিটিং থেকে বের হয়ে যাওয়া)। এ নিয়ে প্রাথমিক একজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিসহ ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নতুন কারিকুলাম তৈরির উদ্যোগ নেয় সরকার। চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) আওতায় প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের হালনাগাদকৃত সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর অনুমোদন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন কারিকুলাম প্রণয়নে দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে কারিকুলাম তৈরিতে একটি কমিটি করে দেয় গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটি কারিকুলাম বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত করে। কিন্তু হঠাৎ আগের রূপরেখায় যোগ্যতা ও শিখনফল বাদ দিয়ে জটিল একটি যোগ্যতার ছক (মেট্রিক্স) জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদিত প্রাথমিক স্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত উপেক্ষা করে ইউনিসেফ, প্লান বাংলাদেশ ও ব্র্যাকের কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় সমন্বিত শিক্ষাক্রম রূপরেখাটি তৈরি করা হয়েছে। আর এনসিটিবির প্রাথমিকের উইং প্রধানকে বাদ দিয়ে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মশিউজ্জামানকে। এ ব্যাপারে শিক্ষাক্রম রূপ রেখা তৈরির প্রধান সমন্বয়ক ও এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মশিউজ্জামান বলেন, কারিকুলাম সব সময় প্রজেক্টের আওতায় তৈরি হয়। সেখানে পরামর্শকরা কাজ করেন। প্লানের যার কথা বলা হচ্ছে তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা। তিনি এক সময়ে লিয়েনে প্লানে কাজ করেছেন। তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে নেওয়া হয়েছে। ব্র্যাকের কেউ নেই। তবে সাবজেক্ট কমিটিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আছেন। ইউনিসেফের পক্ষ থেকে দুইজন কর্মকর্তা প্রাথমিকের ও মাধ্যমিকের কারিকুলামের কাজ দেখছেন। আগেও তারা ইনভল্ব ছিলেন। এনজিওরা কারিকুলাম তৈরি করছে- এটা প্রোপাগান্ডা। অভিযোগকারী বিশেষজ্ঞদের মত, শিক্ষাক্রমের নতুন রূপরেখায় যোগ্যতা ভিত্তিক শিখনফল বাদ দেওয়া হয়েছে। আর অভিজ্ঞতা ভিত্তিক যোগ্যতা যুক্ত করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের সব পাঠই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দিতে হবে। সব কিছু অভিজ্ঞতা দিয়ে হয় না। অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ ছাড়াই অগোছালোভাবে অভিজ্ঞতা ভিত্তিক যোগ্যতাগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। কারিকুলামের রূপরেখার টেম্পলেটে যোগ্যতা ভিত্তিক শিখনফল বাদ দিয়ে সরাসরি বইয়ের কন্টেন্ট লেখার কথা বলা হয়েছে। এভাবে বইয়ের বিষয়বস্তু লিখলে বই ভারসাম্যহীন হয়ে বড় ধরনের গ্যাপ তৈরি হবে। ওই ঘাটতি পূরণে সহায়ক বই (নোট গাইড), কোচিং-প্রাইভেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে শিক্ষার্থীরা। তাদের একাধিক সহায়ক বই কিনতে হবে। অথচ শিখনফল প্রাথমিক শিক্ষায় বহু বছর ধরে চর্চা হচ্ছে। শিক্ষকদের সেভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে তোলা হয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতিতে নতুন রূপ রেখা বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহরের বিদ্যালয়ে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) মশিউজ্জামান বলেন, বর্তমান কারিকুলামে নোট গাইড বা সহায়ক বই তৈরির সুযোগ আছে। নতুন কারিকুলামে তা সম্ভব হবে না। কারণ শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা মূল্যায়নসহ নানা ব্যবস্থা রয়েছে। যে কারণে নোট গাইড তৈরি করা সম্ভব হবে না। বর্তমান ফ্রেম ওয়ার্কের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হওয়ায় নতুন মেট্রিক্স যুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষাক্রমের রূপরেখার অসঙ্গতি তুলে ধরে সংশ্লিষ্টরা জানান, অভিজ্ঞতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ, সরল অংক শেখানোর কথা বলা হয়েছে। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের দোকানে বা প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাওয়া শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়। এনসিটিবির কর্মকর্তারা অভিজ্ঞতার পরিবর্তে পরিকল্পিত কাজ শেখানোর প্রস্তাব করলেও তা পাত্তা দেননি এনজিও কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) প্রফেসর ড. একেএম রিয়াজুল হাসান বলেন, পাঠ্য বইয়ে অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিখনের একটা মাত্রা আছে। কারিকুলাম চূড়ান্ত হলেই অভিজ্ঞতার অংশ কতটুকু আছে, স্কুলে কতটুকু শেখানো হবে, ক্লাসরুমে কতটুকু শেখানো হবে, স্কুল এবং ক্লাস রুমের বাইরে কতটুকু শেখানো হবে তা জানা যাবে। আমি এখন কিছুই জানি না। কেন জানেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাথমিকের দায়িত্ব আমার হলেও সমন্বিত কারিকুলামে আমি লিড দিচ্ছি না। অভিযোগ রয়েছে, প্রাথমিকের নতুন কারিকুলামের রূপরেখা যারা করছেন সে কমিটির অনুমোদন নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। অনুমোদন ছাড়া কমিটি কীভাবে কাজ করছে তা জানতে চেয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সদস্য (অর্থ) মির্জা তারিক হিকমত। তিনি বলেন, এনসিটিবির আইনে বলা আছে এ ধরনের কাজ করতে হলে কমিটি থাকতে হবে। নতুন কারিকুলাম তৈরিতে কমিটির অনুমোদন আছে কি না জানতে চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এই দুই স্তরের শিক্ষার্থী, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষকের যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা ও চর্চার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। দেশের বর্তমান বাস্তবতায় প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম রূপরেখা বাস্তবায়ন কঠিন চ্যালেঞ্জ। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম বলেন, এনসিটিবি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয়। এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে। বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব। মাধ্যমিকের কারিকুলামে গোঁজামিল: মাধ্যমিক স্তরের বর্তমান কারিকুলামে ইতিহাস, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, ইংরেজি ও বাংলা বইয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু নতুন কারিকুলামে তা কমিয়ে ফেলা হয়েছে। নতুন কারিকুলামে নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা নামে কোনো বিভাগ থাকবে না। কলেজে ভর্তির সময় বিভাগ নির্ধারণ করতে হবে। মাধ্যমিক স্তরের পদার্থ, রসায়নসহ অন্যান্য কঠিন বিষয়ে সীমিত জ্ঞান অর্জন করে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এসব বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তবে এ বিষয়ে সমন্বয়ের কোনো নির্দেশনা নেই। এছাড়া বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এটি রূপরেখায় উপেক্ষিত হয়েছে। এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, আইন অনুযায়ী কারিকুলাম তৈরির দায়িত্ব এনসিটিবির কর্মকর্তাদের। কিন্তু এনসিটিবির বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে এনজিও কর্মকর্তারা আমাদের দেশে বাস্তবায়ন অযোগ্য অভিজ্ঞতা ভিত্তিক কন্টেন্ট কারিকুলাম যুক্ত করছেন। ফলে বাড়িতে অভিভাবকদের পক্ষে পড়ানো সম্ভব হবে না। এমন কি শিক্ষকদের পক্ষেও শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষা করে নবম শ্রেণিতে কৃষি শিক্ষা বিষয়টি তুলে দিয়েছে। বিজ্ঞান বইয়ে কৃষি শিক্ষার সামান্য অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত কারিকুলামে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, এনসিটিবি থেকে আমাকে জানানো হয়েছে- ইউনিসেফসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ক্যাডারের কয়েকজন কর্মকর্তা লিয়নে ছিলেন। তাদের কারিকুলাম কমিটিতে এক্সপার্ট হিসেবে রাখা হয়েছে। এনজিও বা বিদেশি সংস্থা এক্সপার্ট হিসেবে থাকতে পারে। কিন্তু সব দায়িত্ব তারা পালন করছে এটা মনে হয় ঠিক না। সচিব তাৎক্ষণিক এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে ফোন করে কারিকুলামের সঙ্গে যুক্ত সব কর্মকর্তাদের তালিকা চান।
Leave a Reply