আগৈলঝাড়া প্রতিনিধি ॥ করোনা মহামারির মধ্যে গ্রামের খেটে খাওয়া দিনমজুর পরিবারগুলোর গত একবছর পর্যন্ত যখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। ঠিক সেই সময় ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীর খামখেয়ালীপনার কারণে ওইসব পরিবারের কাছে তাদের পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া বাড়ির জমি এখন জম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূক্তভোগীদের অভিযোগে জানা গেছে, বাড়ির খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) আদায়ের নামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিনমজুর পরিবারগুলোর কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হলেও নামমাত্র টাকার রশিদ ধরিয়ে দিচ্ছেন ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক ও অস্থায়ীভিত্তিতে নিয়োগকৃত কর্মচারী। এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে দিনমজুর পরিবারের সম্পত্তি খাস জমিতে অর্ন্তভূক্ত করে দেওয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে। ফলে নিরুপায় হয়ে এলাকাবাসী ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মচারীদের দাবিকৃত টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতারনার মাধ্যমে এভাবেই অতিরিক্ত টাকা আদায়ের মাধ্যমে লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মচারী। ঘটনাটি জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের। অনুসন্ধানে রাজিহার ইউনিয়নের কান্দিরপাড় চেঙ্গুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা বিনোদ বিহারী বেপারী অভিযোগ করেন, বকেয়া ভূমি উন্নয়ন কর উত্তোলনের জন্য গৈলা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক মোঃ সুমন হাওলাদার বাড়ি বাড়ি গিয়ে দীর্ঘদিন থেকে মনগড়া ভাবে বাৎসরিক খাজনার চেয়ে অতিরিক্ত টাকা দাবি করেন। এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের সম্পত্তি খাস জমিতে অর্ন্তভূক্ত করে দেওয়ার হুমকি দেয় সুমন। ফলে তারা নিরুপায় হয়ে সুমনের দাবিকৃত টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, সরকার নির্ধারিত প্রতি শতক জমিতে বছরে ১০ টাকা হিসেবে তার কাছে ৩৮ মাসের ৩৮০ টাকার খাজনা বকেয়া রয়েছে। সেখানে অফিস সহায়ক সুমন খামখেয়ালী ভাবে ও জমি খাস করার হুমকি দিয়ে তার কাছ থেকে নগদ তিন হাজার টাকা নিয়েছেন। টাকা নেয়ার এক সপ্তাহ পর অন্যলোকের মাধ্যমে বাড়িতে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রশিদ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গৈলা ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেনের সিল ও স্বাক্ষরিত ওই রশিদে সুমনের নেয়া তিন হাজার টাকার পরিবর্তে বকেয়া খাজনার ৩৮০ টাকা ও বিবিধ খরচ ১০ টাকা উল্লেখ করে রশিদে ৩৯০ টাকা লেখা হয়েছে। একই গ্রামের বিজেন্দ্র নাথ হালদারের কাছে ১৮ মাসের বকেয়া ১৮০ টাকার স্থলে ২৫শ’ টাকা নেয়া হলেও তার রশিদে ১০ টাকা বিবিধ খরচ দেখিয়ে ১৯০ টাকা, হরিহর মন্ডলের কাছে বকেয়া ৪১০ টাকার স্থলে দুই হাজার টাকা নিয়ে তার রশিদে ১০ টাকা বিবিধ খরচ দেখিয়ে ৪২০ টাকা, গোবিন্দ হালদারের কাছে বকেয়া ১১০ টাকার স্থলে এক হাজার টাকা নিয়ে তার রশিদে ১০ টাকা বিবিধ খরচ দেখিয়ে ১২০ টাকা, হরিদাস মন্ডলের কাছে বকেয়া ৬০ টাকার স্থলে সাতশ’ টাকা নিয়ে তার রশিদে মাত্র ৬০ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। খাজনা উত্তোলনের নামে এভাবেই প্রতারনার মাধ্যমে পুরো রাজিহার ইউনিয়ন থেকে লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ভূমি অফিসের অসাধু কর্মচারীরা। ওই ইউনিয়নের চেঙ্গুটিয়া বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম হাওলাদার ওরফে কেদার আলী অভিযোগ করেন, অফিস সহায়ক সুমন হাওলাদার বাড়ির বকেয়া খাজনা বাবদ তার কাছে সাড়ে ছয় হাজার টাকা দাবি করেন। তিনি অতিরিক্ত টাকা দিতে অস্বীকার করায় তার সম্পত্তি খাস জমিতে অর্ন্তভূক্ত করে দেওয়ার হুমকি দেয় সুমন। পরবর্তীতে তিনি গৈলা ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেনের স্মরনাপন্ন হন। তাকে বিষয়টি অবহিত করার পর তিনি (জাহাঙ্গীর) বিষয়টি নিস্পত্তির জন্য সাড়ে চার হাজার টাকা দাবি করেন। এনিয়ে ভূমি কর্মকর্তার সাথে বাকবিতন্ডা হলে ওই অফিসের এক দালাল তার (নুরুল) কাছে সর্বসাকুল্যে তিন হাজার টাকা দাবি করেন। সম্পত্তি খাস জমিতে অর্ন্তভূক্ত করার হুমকি দিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ ও নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে অফিস সহায়ক মো. সুমন হাওলাদার মোবাইল ফোনে বলেন, অনলাইনে খাজনা পরিশোধের জন্য বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও মোবাইল নাম্বার সংগ্রহের জন্য অস্থায়ীভিত্তিতে এক কর্মচারীকে নিয়োগ করা হয়। সে অনিয়ম করে কয়েকজনের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা উত্তোলণ করেছিলো। পরবর্তীতে অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। এখনও কয়েকজনের টাকা পরিশোধ করা হয়নি দাবি করে সুমন হাওলাদার আরও বলেন, লকডাউন শেষে ওইসব ব্যক্তিদের অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেয়া হবে। অপরদিকে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য সুমন হাওলাদারের মোবাইল ফোন থেকে এক নারীকে দিয়ে এ প্রতিনিধিকে হুমকি প্রদর্শন করা হয়। গৈলা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কথা শুনে জরুরী ভিত্তিতে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য অভিযুক্ত সুমন হাওলাদারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম হাওলাদার ওরফে কেদার আলীর কাছে তিনি (জাহাঙ্গীর) নিজেই সাড়ে চার হাজার টাকা দাবির অভিযোগের বিষয়ে কোন মন্তব্য না করে এ ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য তিনি অনুরোধ করেন। সংশ্লিষ্ট রাজিহার ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইলিয়াস তালুকদার এ বিষয়ে বলেন, বিষয়টি তার কাছে কেউ জানায় নি। তিনি জানলে ইউএনও’র মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। ঢাকা থেকে চিকিৎসা গ্রহন শেষে বাড়ি ফিরে তিনি এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে ইউএনও’র সাথে আলোচনা করে জনগনের কষ্ট লাঘবের ব্যবস্থা করবেন বলেও জানান তিনি। আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবুল হাশেম বলেন, ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) আদায়ের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়ে এখনও কেউ আমার কাছে অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Leave a Reply