বিশেষ প্রতিনিধি ॥ একে তো করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় হিমশিম অবস্থা, তার ওপর বরিশাল বিভাগে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই মিলছে না। ফলে অনেক ডায়রিয়া রোগীকে মেঝে, বারান্দা ও গাছতলায় থাকতে হচ্ছে। রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, যথাযথ সেবা যেমন মিলছে না, তেমনি ওষুধ ও স্যালাইন কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে। স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৬৯৩। এর মধ্যে ডায়রিয়ায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এই সাড়ে তিন মাসে বিভাগের ছয় জেলার মধ্যে বরিশালে ৩ হাজার ২১৭, পটুয়াখালীতে ৫ হাজার ৯২০, ভোলায় ৬ হাজার ৬০৬, পিরোজপুরে ৩ হাজার ৪৮৬, বরগুনায় ৪ হাজার ৪০ ও ঝালকাঠিতে ২ হাজার ৪২৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। তবে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে, এমন রোগী হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চেয়ে অনেক বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৮ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল এক মাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে, যা মোট আক্রান্তের প্রায় অর্ধেক। এই সংখ্যা ১২ হাজার ৮৯৬। আবার এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আক্রান্তের গতি আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় সপ্তাহে, অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাত দিনে বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ৫৭৭ জন। তিনজন রোগীর মৃত্যুও হয়েছে এই সপ্তাহে। এর মধ্যে বরগুনা জেলায় একজন ও অন্য দুজন বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার। বরিশাল জেনারেল হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শয্যা আছে মাত্র চারটি। অথচ প্রতিদিন গড়ে ভর্তি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী। মার্চে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ৭৫১ জন ডায়রিয়া রোগী। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ৫১২ জন। রোগীদের চাপ সামলাতে গত মঙ্গলবার কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল চত্বরে শামিয়ানা টানিয়ে রোগীদের শয্যা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ১০ শয্যার একটি ডায়রিয়া ওয়ার্ড আছে। সেখানে প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে। শয্যা না পেয়ে রোগীরা মেঝেতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। হঠাৎ করে ডায়রিয়া রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, জানুয়ারি থেকে বরগুনায় ডায়রিয়ার প্রকোপ শুরু হয়। ওই মাসে এখানে ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে ১৭৮ জন। ফেব্রুয়ারিতে তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ২০৩ জনে। আর মার্চে তা প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে পৌঁছায় ৯২৮ জনে। এপ্রিলের ১৩ দিনে ভর্তি হয়েছে ৫৫০ জন। রোগীদের চাপে এবং শয্যা না পেয়ে বেশির ভাগ রোগীকে মেঝে, বারান্দা, করিডরে শয্যা নিয়ে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এখানে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন আলেয়া বেগম বলেন, হাসপাতালে মানুষ আসে সুস্থ হওয়ার জন্য, কিন্তু এখানকার যে অবস্থা, এতে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে হচ্ছে। চারদিকে থেকে দুর্গন্ধ; মশা–মাছি ভনভন করছে। পরিবেশ এতটাই নোংরা যে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে। অন্য এক রোগী বললেন, দুটি মাত্র শৌচাগার। যার অবস্থাও করুণ। এখান থেকে কিছুই পাওয়া যায় না। বাইরে থেকে স্যালাইন এনে দিতে হয়। ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসার জন্য বিভাগের ৬ জেলায় ৪০৬টি টিম কাজ করছে বলে জানায় স্বাস্থ্য বিভাগের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয়ের সূত্র। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। এতে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের ওপর চাপ বেড়েছে। করোনার পাশাপাশি ডায়রিয়ার বিষয়েও আলাদা নজর রাখা হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে খাবার ও আইভি স্যালাইনের সংকট নেই। তিনি আরও বলেন, ডায়রিয়া বেড়ে যাওয়ার পেছনে আবহাওয়ার বৈপরীত্য বড় কারণ। তবে গরমে রাস্তার পাশের শরবত পান, অপরিষ্কার–অপরিচ্ছন্ন থাকা, অনিরাপদ পানি পান ও খাবার খাওয়ার কারণে গরমের এই সময়ে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেওয়ার পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। বাইরের যেকোনো খাবার বর্জন করার পরামর্শ দেন তিনি।
Leave a Reply