দখিনের খবর ডেস্ক ॥ তাপদাহ ও শিলাবৃষ্টিতে দেশের হাজার হাজার কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছে। করোনাকালে নতুন এ সঙ্কটে কৃষকের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। উচ্চ তাপমাত্রা বা ‘হিটশক’ দেশের কৃষিতে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শিলাবৃষ্টি ও গরম বাতাস ওই দুই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবার চালের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর উৎপাদন কম হলে বাজারে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে বিগত কয়েক মাস ধরেই চালের দাম উচ্চপর্যায়ে রয়েছে। সরবরাহ পরিস্থিতি বাড়াতে ইতিমধ্যে সরকারিভাবে চাল আমদানি করা হচ্ছে। তাছাড়া বেসরকারিভাবে চাল আমদানি উৎসাহিত করা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের প্রায় ৩৬ জেলার উপর দিয়ে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই তাপদাহ বয়ে যায়। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি জেলায় আঘাত হেনেছে শিলাবৃষ্টিও। তাপদাহ ও শিলাবৃষ্টিতে ইতিমধ্যে ৬৯ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মধ্যে পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে ২১ হাজার হেক্টর জমির ধান। অথচ সেখান থেকে প্রায় এক লাখ টন চাল আসতে পারতো। আর বাকি জমিগুলোর ধান বিভিন্ন মাত্রায় বিশেষ করে ১০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন মাত্রায় ভুট্টারও ক্ষতি হয়েছে। কৃষিবিদদের মতে, দেশে ফসলহানির ক্ষেত্রে এটি প্রায় নতুন ধরনের দুর্যোগ। কারণ প্রচণ্ড গতিতে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে গরম বাতাস আগে কখনো দেখা যায়নি। সূত্র জানায়, দীর্ঘদিনের বৃষ্টিহীনতাই হচ্ছে উচ্চ তাপদাহের কারণ। তাপদাহে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা এবং গোপালগঞ্জ, নড়াইল, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও ময়মনসিংহসহ দেশের বেশকিছু অঞ্চলে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাপদাহে প্রাথমিকভাবে প্রায় ৪৮ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তী সময়ে তাপদাহে ফসলের আরো ক্ষতি হয়। ফলে তাপদাহে ক্ষতির পরিমাণ ৫৫ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া সারা দেশে বেশকিছু স্থানে শিলাবৃষ্টির কারণেও ধানের ক্ষতি হয়েছে। শিলাবৃষ্টিতে ৫-৬ হাজার হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আংশিক ক্ষতির পরিমাণ বেশি। তবে তাপদাহে আগাম ধানে বা ধানের ফুল এসেছে এমন জমিতে বেশি ক্ষতি হয়েছে। যেসব জমির ধান ফুল ফোটা পর্যায়ে ছিল না সেগুলোর তেমন ক্ষতি হয়নি। যেখানে ফুল ফোটা পর্যায়ে ছিল সেটাতে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, উচ্চ তাপমাত্রা থেকে ধান রক্ষায় করণীয় একমাত্র উপায় হচ্ছে ধানের জীবনকালের ওপর ভিত্তি করে বপন ও রোপণ সময় এমনভাবে সমন্বয় করা, যাতে ধানের ফুল ফোটার সময় কালবৈশাখী ও তীব্র তাপদাহ এড়িয়ে যাওয়া যায়। এ সময় বোরো ধানের যেসব জাত ফুল ফোটা পর্যায়ে আছে বা এখন ফুল ফুটছে বা সামনে ফুল ফুটবে, সেসব জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখতে হবে এবং ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই ২-৩ ইঞ্চি পানি রাখতে হবে। তাছাড়া বোরো ধানের এ পর্যায়ে নেক ব্লাস্ট বা শীষ ব্লাস্ট রোগেরও ব্যাপক আক্রমণ হতে পারে। শীষ ব্লাস্ট রোগ হওয়ার পরে তা দমন করার সুযোগ থাকে না। সেজন্য ধানের জমিতে রোগ হোক বা না হোক, থোড় ফেটে শীষ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একবার এবং এর ৫-৭ দিন পর আরেকবার বিঘাপ্রতি (৩৩ শতাংশ) ৫৪ গ্রাম ট্রুপার ৭৫ ডব্লিউপি/ দিফা ৭৫ ডব্লিউপি/ জিল ৭৫ ডব্লিউপি অথবা ৩৩ গ্রাম নাটিভো ৭৫ ডব্লিউজি অথবা ট্রাইসাইক্লাজল/স্ট্রবিন গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় ৬৭ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে শেষ বিকালে স্প্রে করতে হবে। তাছাড়া খুব দ্রুত তাপসহিষ্ণু জাত সম্প্রসারণ করা জরুরি। তা নাহলে আগামী মৌসুমে এ ধরনের দুর্যোগ দেখা দিলে কৃষকের আরো বেশি ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি বছর বোরো ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে চাষ করা হয়েছে। ফলে বোরোর আবাদ দাঁড়িয়েছে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টরে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড আবাদ বাড়ানো হয়। ফলে শিলাবৃষ্টি ও তাপদাহে ধান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে চালের উৎপাদন খুব বেশি কম হবে না। তবে ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে কৃষকদের কী ধরনের সহায়তা দরকার এবং বিকল্প কীভাবে আবাদ ধরে রাখা যায় মাঠ পর্যায়ের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা সে বিষয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর জানান, বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বুঝতে পেরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৩ সাল থেকে উচ্চ তাপমাত্রাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে গবেষণা শুরু করে। উচ্চ তাপমাত্রাসহিষ্ণু এন২২ জাতের সঙ্গে বোরো মৌসুমের জনপ্রিয় আধুনিক জাত ব্রি ধান২৮-এর সংকরায়ণ করে মার্কার অ্যাসিস্টেড ব্যাকক্রসিং পদ্ধতির মাধ্যমে একটি অগ্রগামী সারি নির্বাচন করেছে। এটি মধ্যম মাত্রার উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল। এ সারিটি বর্তমানে আঞ্চলিক ফলন পরীক্ষণ পর্যায়ে রয়েছে। ফলন ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য গ্রহণযোগ্য হলে অবমুক্তির উদ্যোগ নেয়া হবে। এ জাতটি ফুল ফোটা পর্যায়ে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলেও এ সারিটি আশানুরূপ ফলন দিতে পারবে। ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯-এর ব্যাকগ্রাউন্ডে আরো ১৬টি উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল সারি অগ্রগামী করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ জানান, তাপদাহ নতুন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর পাশাপাশি শিলাবৃষ্টিতেও ফসলের বেশ ক্ষতি হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়েছে এমন ধানের পরিমাণ খুব বেশি হবে না। আংশিক বা সামান্য ক্ষতির শিকার হয়েছে বেশি। তবে যতটুকুই ক্ষতি হোক না কেন ডিএই কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাছাড়া এ সময়ে করণীয় বিষয়ে কৃষকদের সব ধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে সম্প্রসারণ কর্মীরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। আশা করা যায় নতুন এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে।
Leave a Reply