দখিনের খবর ডেস্ক ॥ উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের পর থেকেই আমাদের এ ভূখণ্ড ক্রমেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবেই তৎকালীন পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু ধর্মের বন্ধন ১১০০ মাইলের দূরের দুই ভূখণ্ডকে এক করে রাখতে পারেনি। নিজস্ব স্বকীয়তা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও আবহমানকাল থেকেই বাংলার ঐতিহ্য হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। বাংলার সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সব সময়ই শান্তি, সম্প্রীতি, সহযোগিতা এবং উদার মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। স্বার্থান্বেষী রাজনীতির কূটচালে কখনও কখনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিলক্ষিত হলেও সাধারণ নাগরিকরা প্রায়ই ঝুঁকি নিয়ে একে অপরকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। বাংলার মুসলমানদের আদর্শ, মূল্যবোধ ও ধর্মচর্চা মূলত বহিরাগত সুফি-দরবেশ ও ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ধর্মীয় নির্দেশনা পরিপালনের পাশাপাশি তারা চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির নানা উপাদানকে সমান মমতায় ধারণ করতেন। সুফি-দরবেশ ও ধর্ম প্রচারকরাও এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। ফলে বাঙালি অমুসলিমদের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানেও কোনো সমস্যা পরিলক্ষিত হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশেও শাশ্বত বাঙালি সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু অবৈধ সামরিক শাসকরা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং রাষ্ট্রধর্ম, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসকগোষ্ঠীও এ ধারা থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেননি। ফলে ঐতিহ্যবাহী, উদার, প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ‘বাঙালিয়ানা’ বা ‘বাঙালিত্ব’ ক্রমেই ক্ষীণ হতে থাকে। গত তিন দশকে বাঙালি ‘মুসলমান’দের মধ্যে বিস্তর পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। তাদের একটি অংশ বাঙালি সংস্কৃতিকে ‘হিন্দুয়ানি’ বলে বিবেচনা করেন। গ্রাম থেকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রায় উঠে গেছে। সেখানে কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন নেই। হারিয়ে যেতে বসেছে লোকজ মেলা, লোকসংস্কৃতি, জারিগান, পালাগান, যাত্রা কিংবা পাড়া-মহল্লার নাটক-থিয়েটার। এমনকি খেলাধুলার সুযোগও অনেক সীমিত হয়ে গেছে। আগে গ্রামাঞ্চলেও বড় বড় টুর্নামেন্ট আয়োজিত হতো। এখন সেগুলোকে কল্পকাহিনি বলে মনে হয়। অথচ গ্রামে-গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় আয়োজিত হয় সাপ্তাহিক, মাসিক এবং বার্ষিক তালিম, জলসা, ওয়াজ মাহফিল, তাফসির মাহফিল, খতমে কোরআন, খতমে বুখারি। ঘরে ঘরে নানা তরিকার পীরের ভক্ত-মুরিদ এবং ওয়ায়েজিনদের শিষ্য-অনুসারী। এসব মুরিদ-অনুসারীদের অধিকাংশই নিরক্ষর কিংবা স্বল্প শিক্ষিত। তারা কোরআন-হাদিস না বুঝলেও হুজুরের নসিহত অনুসরণে পারঙ্গম। গত ৩০ বছরে দেশে মাদ্রাসা, মসজিদ, খানকা বেড়েছে কয়েকগুণ। ধর্মচর্চার সূচকে আমাদের দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের নৈতিকতা চর্চার কী অবস্থা? সমাজ থেকে ঘুষ-দুর্নীতি, প্রতারণা, অর্থ লোপাট, স্বজনপ্রীতি, জবরদখল, অপরাধ প্রবণতা কী কমেছে? রাজস্ব ফাঁকি, গ্যাস-বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ, ঋণখেলাপি, মজুদদারি, কালোবাজারি, খাদ্যে ভেজাল, ওজনে কম দেওয়া, মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসা ফাঁদা কি বন্ধ হয়েছে? অর্পিত দায়িত্ব পালন, সামাজিক ন্যায়বিচার, মা-বাবা, নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী, দরিদ্র এবং এতিমের হক আদায়ে আমরা কতটা তৎপর? মাদকাসক্তি, পর্নোসক্তি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌতুক কেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে? রাসুলের (স.) আদর্শ মোতাবেক অপরের সঙ্গে সুন্দর ও মানবিক আচরণও আমরা ভুলতে বসেছি। বরং দাঙ্গা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি, জ্বালাও-পোড়াও, জানমালের ক্ষতিসাধনকে অনেকে ধর্মীয় দায়িত্ব বলে মনে করছেন! যে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান এবং ধর্মচর্চায় যাদের সীমাহীন আবেগ, আগ্রহ এবং ভক্তি রয়েছে, সেখানে কেন নৈতিকতার এই দৈন্যদশা? বিশ্বে অনেক দেশ আছে যেখানে এত বেশি মুসলমান নেই, ধর্মচর্চায়ও কোনো বাড়াবাড়ি নেই। কিন্তু সেখানে উচ্চমাত্রায় নৈতিকতা আছে। সেখানে দুর্নীতি নেই, ভেজাল নেই, প্রতারণা নেই। নেই ধর্ষণ, নারী নির্যাতন। তারা অনেক বেশি বিনয়ী, মানবিক। অথচ সততা, বিনয়, নৈতিকতা ও মানবিকতা ইসলামের মূল শিক্ষা। আমাদের সমাজে দৃশ্যমান ধর্মচর্চার ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হলেও ইসলামের মূল শিক্ষা অর্জনে আমরা অনেক বেশি পিছিয়ে রয়েছি। ধর্মীয় আদর্শ নৈতিকতার উন্নতি ঘটায়, মানুষকে সৎ ও মানবিক হতে শেখায়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান ধর্মচর্চা আমাদের মধ্যে সততা, নৈতিকতা ও মানবিকতার বিকাশ ঘটাতে পারছে না। তার অর্থ হচ্ছে, আমরা ধর্মের মূল শিক্ষা, দর্শন ও আদর্শ থেকে দূরে রয়েছি। অন্যদিকে, আমরা আমাদের চিরন্তন সংস্কৃতিকেও দূরে ঠেলে দিয়েছি। ফলে আমরা অনেকটা মূলোৎপাটিত উদ্বাস্তু জাতিতে পরিণত হচ্ছি। আমাদের নৈতিকতার দ্বন্দ্ব ও অবক্ষয়ের এটাই হয়তো প্রধান কারণ।
Leave a Reply