বিশেষ প্রতিনিধি ॥ পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার খালগোড়া ঘাটে স্তুপ করে রাখা হাজার হাজার তরমুজ। মোবাইল ফোনে বাজারদরের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন চাষী। মৌসুমের শুরু থেকেই তরমুজের দাম চড়া। তবে রমজান আর বৈশাখের খরতাপকে কেন্দ্র করে সবুজ তরমুজেও আগুন লেগেছে। যে আগুনে নিম্মমধ্যবিত্ত তো দূরের কথা, মধ্যবিত্তরাই পুড়ে ছারখার। অথচ দেশজুড়ে চলমান তীব্র তাপদাহে ইফতারের প্রধান উপকরণ হওয়ার কথা তরমুজ। পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এই তরমুজ এখন রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এই সুযোগে বিক্রেতাদের মুনাফা চরমে। চলতি সপ্তাহে খুচরা বাজারে এক কেজি তরমুজের দাম চলছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি। বেশি ভালো মানেরগুলো ৬৫ থেকে ৭০ টাকাতে বিক্রি হচ্ছে। এতে ৫ কেজির একটি তরমুজের জন্য ক্রেতার গুণতে হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা! অথচ এই তরমুজের দাম ১৫০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। প্রতি তরমুজ কমপক্ষে ১০০ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে! রাজধানীর নাগরিকরা মনে করেন, কেজি দরে বিক্রির কারণেই এমন দাম উঠেছে। এতো ভারী একটি ফল ছোট পরিবারের জন্য কিনতে গেলেও ৫ কেজির নিচে হয় না। প্রশ্ন উঠেছে, এতো দাম হাঁকানো তরমুজের উৎপাদক প্রান্তিক চাষিরা কেমন দাম পাচ্ছেন? তারা পাইকারি বিক্রেতা বা আড়তদারদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করায় কি আজ তরমুজের বাজারে আগুন? তারাও কি ব্যবসায়ীদের কাছে কেজি দরে বিক্রি করেন? এ বিষয়ে তরমুজের দেশ হিসেবে সুপরিচিত রাঙ্গাবালীর বেশ কয়েকজন তরমুজ চাষির সঙ্গে কথা বলেছেন রাঙ্গাবালীর কামরুল হাসান। সব চাষিরাই জানিয়েছেন, ক্ষেত থেকে তোলা তরমুজ তারা কেজিতে বিক্রি করছেন না। শ’ হিসেবে বিক্রি করেন বেশিরভাগ চাষি। রাঙ্গাবালী উপজেলার নিজ হাওলা গ্রামের চাষি শামছুল আলম বলেন, ‘বর্তমান বাজারে স্থানীয়ভাবে ১০ কেজি ওজনের তরমুজ পাইকারদের কাছে শ’ হিসেবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় নিয়ে বিক্রি করলে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দরে তরমুজ চলছে।’ ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের তরমুজ চাষি মজিবুর রহমান মিন্টু জানান, আড়তদারদের কাছে ২ কেজি ওজনের তরমুজ সর্বোচ্চ ৫০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন তারা। ১০০ টাকায় যে তরমুজ বিক্রি হয় তার ওজন ৭-৮ কেজি হয়। একই গ্রামের আরেক তরমুজ চাষী জাহিদ হাসানের মুখেও শোনা গেল একই তথ্য। এবার আড়তদারদের কাছে এই দামে তরমুজ বেচেই অনেক লাভবান তারা। সে হিসেবে পরিবহনে উঠিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত ১০ কেজি ওজনের তরমুজের দাম ২০০-২৫০০ টাকা, যা ঢাকায় আসার পর হয়ে যাচ্ছে ৬০০ টাকা! পরিবহনে এতো খরচ? এ বিষয়ে জানা গেছে, সিন্ডিকেট ও মধ্যস্তভোগীরা বেশি লাভবান হতে এমন দর বাড়িয়ে দিয়েছেন। চাষিরা যদি সরাসরি ভোক্তাদের কাছে তরমুজ বিক্রি করতে পারে তাহলে দাম অনেক কম হবে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ফেসবুকে অনেকে ক্ষোভ ঝাড়ছেন। পরিবারের জন্য প্রিয় ফলটি না কিনতে পেরে হতাশায় ভুগছেন। মৌসুমি এই ফলটির পুষ্টিগুণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকে কেজি দরে তরমুজ বিক্রিকে ভোক্তাদের সঙ্গে বড় রকমের প্রতারণা ও চালবাজি আখ্যায়িত করছেন। কেজিদরে তরমুজ কিনতে চাচ্ছেন না তারা। কেউ কেউ ‘আঙুর ফল টক’ উপকথার মতো তরমুজ বয়কটের শ্লোগান দিচ্ছেন। কিন্তু ক্রেতাদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। লকডাউন ও ভালো ফলন না হওয়ার অযুহাত দেখাচ্ছেন তারা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কারওয়ান বাজারের এক তরমুজ ব্যবসায়ী বলেন, ‘এ বছর তরমুজের ফলন ভালো হয়নি। এর ওপর চৈত্রের শুরুতেই প্রচণ্ড গরম পড়তে শুরু করায় বেশি দাম পাওয়ার আশায় পরিপক্ক হওয়ার আগেই মাঠ থেকে তরমুজ তুলে বিক্রি করেছেন কৃষকরা। ‘লকডাউনের’ কারণে দেশের বেশির ভাগ তরমুজ উৎপাদন হওয়া বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরমুজ আসতে পারছে না। এজন্য দাম বেশি।’ এদিকে ঘনবসতি ঢাকার বাইরের বিভাগীয় শহরের চিত্রও একই। রাজশাহীর শহরের সবচেয়ে বড় তরমুজের মোকাম হচ্ছে শালবাগান বাজার। সেখানেও চলতি সপ্তাহে ১০ কেজি ওজনের একেকটি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকায়! কেজিতে ৬০ টাকার নিচে পড়ছে না। তাই অনেক ক্ষেত্রে বড় একটি তরমুজ কিনে দু’জন ক্রেতা সমান করে ভাগ করে নিচ্ছেন এখন। মহানগরীর সাহেব বাজর থেকে রোববার ৫ কেজি ওজনের একটি তরমুজ দামাদামি করে ২৯০ টাকায় কিনেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস নামের এক ক্রেতা। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘মৌসুম এলে আমাদের পরিবারের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে তরমুজ। তরমুজ ছাড়া ইফতার কল্পনাও করতে পারে না আমার পরিবার। আজ ২৯০ টাকায় ৫ কেজি ওজনের একটি কিনলাম। ৫৮ টাকা করে পড়েছে। এরচেয়ে বড় কিনলে কেজিতে ৬০-৬৫ পড়ে যায়। এই রমজানে হয়তো তরমুজ কিনেই দেউলিয়া হয়ে যাব।’ তরমুজের এতো দাম বাড়ানোর পেছনে কি সেই সিন্ডিকেট দায়ী? মহানগরীর শালবাগান এলাকায় তরমুজ ব্যবসায়ী রিয়াজ আলী সিন্ডিকেটের বিষয়টি অস্বীকার করেন। দাম বাড়ার প্রসঙ্গে সেই লকডাউনের অযুহাতই তুললেন। বললেন, ‘লকডাউনের’ কারণে বরিশাল ও খুলনা থেকে তরমুজ আসতে পারছে না। যে কারণে মোকামেই প্রতি কেজি তরমুজ ৫০ টাকা থেকে ৫২ টাকা কিনতে হচ্ছে আমাদের। সেই তরমুজ ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করাটা দোষের দেখছি না। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। জানা গেছে, খুলনা মহানগরের পাইকারি বাজার দৌলতপুর এবং বড় বাজারেও কেজি দরে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। সেখানে এখন কেজি সর্বনিম্ন ৫০ টাকা কেজি চলছে। সত্যি কি এবার তরমুজের ফলন কম? ফিরে যেতে হয় তরমুজের লালে রাঙ্গা পটুয়াখালীর উপজেলা রাঙ্গাবালীতে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তরমুজের এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। গতবছর করোনা পরিস্থিতির কারণে যেসকল চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এ বছর সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পেরেছেন তারা। ইতোমধ্যে তরমুজ বিক্রি শেষ প্রায়। কমবেশি সব চাষী এবার লাভবান।’ বরিশালের অন্যান্য অঞ্চলেও তরমুজের ফলন ভালো হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বক্তব্য, চলতি বছর তরমুজের উৎপাদন অন্যান্য বছরের তুলনায় ভালো। এ বছর দেশে ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে, যার ৬২ শতাংশ হয়েছে বরিশাল বিভাগে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় হেক্টরপ্রতি গড়ে ৫০ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদিত হয়েছে, যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বেশি। তবে কি শুধুই গত ১৪ এপ্রিল থেকে চলা দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে এই দাম বৃদ্ধি? এ ব্যাপারে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান বলেন, ‘লকডাউনের জন্য জারিকৃত সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কৃষিপণ্য হিসেবে তরমুজ পরিবহনে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কৃষকরা নির্বিঘ্নে তরমুজ বাজারজাত করেছেন। কোনো ধরনের সমস্যা হলে কৃষকদের সরাসরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল। কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের সব ধরনের সহায়তা করা হয়।’ তাহলে কোন ইস্যুতে বাড়ল এই তরমুজের দাম? সেই প্রশ্ন রয়েই গেল।
Leave a Reply