রাজাপুর প্রতিনিধি ॥ ‘রাজাপুর সদরের প্রধান খাল ও এর শাখা খালগুলো দিয়ে এক সময় বড় বড় নৌযান চলাচল করতো। অথচ দখলের কারণে খালগুলো এখন নালায় পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি খালপাড়ের বাসিন্দারা অবিবেচনা প্রসূত খালে ময়লা-অবর্জনা ফেলে এবং খালের সাথে পয়ঃনিষ্কাশন সংযোগ দিয়ে এর যেটুকু পানি অবশিষ্ট আছে তাও ব্যবহারের অনুপযোগী করে ফেলেছেন। তারপরেও যারা খালের পানি ব্যবহার করছেন তারা ডায়রিয়া ও কলেরার মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে খাল দখল ও দূষণ করা হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই দখলবাজদের অনেকটাই বেপরোয়াভাবে দখল ও খালের পানি দূষিত করতে দেখা যাচ্ছে’। কথাগুলো বলছিলেন উপজেলা সদরের বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রাণবল্লব সাহা (৭০)। জানা যায়, উপজেলা সদরের মধ্য দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার এঁকেবেঁকে চলেছে রাজাপুর খাল। এই খালের মূল স্রোতধারার সাথে উপজেলা সদরের বুকচিড়ে প্রবাহিত হয়েছে আরো অন্তত তিনটি শাখা খাল। যার মাধ্যমে এতদিন ধরে উপজেলা সদরে বসবাস করা প্রায় ২০ হাজার মানুষ তাদের কৃষি কাজ, মাছধরাসহ দৈনন্দিন সাংসারিক পানির চাহিদা মিটিয়েছে। তবে বর্তমান চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। উপজেলা সদরের মধ্য থেকে প্রবাহিত মূল খালটি দখল ও দূষণের কারণে এখন অস্তিত্ব-সংকটে পড়েছে। আর এর শাখা খালগুলোর দুই পাড় যে যার মতো ভরাট দিয়ে দখল করে নিয়েছেন এবং খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলে ও খালের পানিতে পয়ঃনিষ্কশন সংযোগ দিয়ে তা দূষিত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এদিকে প্রতিদিনই উপজেলা সদরে মানুষ বাড়ছে, কমছে খালের পানির প্রবাহ। ফলে কৃষিতে ও জনস্বাস্থের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যেই চলছে খাল দখল ও দূষণ। মাঝে মাঝে কিছু সামাজিক সংগঠন এর প্রতিবাদ করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এতদিন তেমন কোনো প্রতিকার লক্ষ্য করা যায়নি। তবে সম্প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ দখলদার ও যারা খালের পানি দূষিত করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর ভোট হারাবার ভয়ে জনপ্রতিনিধিরা কখনোই এর প্রতিবাদ করেন না। ফলে নির্ভয়ে ও প্রকাশ্যেই চলছে খাল দখল ও দূষণ। উপজেলা সদরের মধ্য দিয়ে প্রবাহমান প্রধান খালটির সাথে বেশকিছু শাখা খাল যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে উপজেলা সদরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিনটি খাল। সেগুলো হলো, কবিরাজ বাড়ি খাল (বাজারের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে বাইপাস মোড় পর্যন্ত), পূর্ব রাজাপুর শাখা খাল (সাউথপুর সেতু এলাকা থেকে উপজেলা পরিষদ হয়ে ডাকবাংলো মোড় এলাকা হয়ে আবার প্রধান খালে মিশেছে), ডেপুটি বাড়ি খাল (বাঘরি সেতু এলাকা হয়ে সরকারি বালিকা বিদ্যালয় পর্যন্ত) যার এখন অস্তিত্বই নেই। এই সব খাল দিয়ে এক সময় বড় বড় নৌযান চলাচল করতো। বর্তমানে এই শাখা খালের অধিকাংশই দখল হয়ে গেছে। দখলদাররা খালের ওপর নির্মাণ করেছেন বহুতল ভবন, গোসলখানা, পয়ঃনিষ্কাশন ট্যাংকি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান ও গাছের বাগান। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি নামতে না পারায় শহরে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। আর শুষ্ক মৌসুমে শহরের কোথাও আগুন লাগলে তা নেভানোর মতো পানি পাওয়া যায় না। দখল দূষণে পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। উপজেলা সদরের জেলে আবুল হোসেন বলেন, এই খালগুলোতে মাছ ধরেই জীবন চলতো আমার। গত কয়েক বছর ধরে দখলের কারণে খালের আয়তন ছোট হয়েছে, পাশাপাশি খালে পানি প্রবাহও কমে গেছে। ফলে এখন আর এই খালগুলোতে মাছের ঠাঁই হচ্ছে না। তাই আমাকে পেশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। আজ আমরা খালকেন্দ্রিক পেশার কিছু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। অদূর ভবিষ্যতে এই শহরের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ মঞ্চের আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ্ বলেন, কিছু লোভী মানুষের কারণে ধীরে ধীরে নদী মরে খাল হচ্ছে, খাল মরে নালায় পরিণত হচ্ছে, পরে তা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গা দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, এখানে কখনো প্রবাহমান খাল ছিল। আমরা বিভিন্ন সময়ে এই অপকর্মের প্রতিবাদ করছি। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ প্রতিকার করা হচ্ছে না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোক্তার হোসেন বলেন, যারা অবৈধভাবে খাল দখল করেছে এবং খালের সাথে পয়ঃনিষ্কাশন সংযোগ দিয়েছে তাদের এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ দখল ও দূষণ বন্ধ না করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Leave a Reply