স্টাফ রিপোর্টার ॥ শনিবার ঘড়ির কাটায় বেলা তখন সাড়ে এগারোটা। বরিশাল নগরীর আগরপুর রোডস্থ দি মুন মেডিকেল সার্ভিস এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অফিসে রোগী সেজে ঢুকলো এই প্রতিবেদক সহ আরো দুজন। ঢোকার আগেই রোগীর সঙ্গে জুটলো অপরিচিত দুজন। রোগীর জন্য কোন ডাক্তার দেখানো ভালো হবে, কি কি টেস্ট করতে হবে ইত্যাদি সব বিষয়েই আগ বাড়িয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন দ মুন মেডিকেল সার্ভিসের দাবিকৃত চেয়ারম্যান শাহিন। রোগের উপসর্গ জেনে প্রতিষ্ঠানটির সদস্যরা একের পর এক পরীক্ষা ও টেস্টের নির্দেশনা দিচ্ছিলো। রোগীর সাথে থাকা একজন টেস্টের ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নেবার কথা বললে, ঐ দুজন জানান অনেক টাকার টেষ্ট লাগবে টাকা পয়সা আছে তো?। এসব কথার একপর্যায়ে রোগী সেজে থাকা এই প্রতিবেদক এবং তাঁর সঙ্গে থাকা দুজন যখন গণমাধ্যমকর্মীর পরিচয় দেন তখন থতমত খেয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির সদস্যরা। সেখানে প্রবেশের সময় সঙ্গী হওয়া দুজনের পরিচয় জানতে চাওয়া হলে একজন নিজেকে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান দাবি করেন। আর ডাক্তার দেখাবার পূর্বেই এতসব টেস্ট কেন করতে হবে এমন প্রশ্ন করা হলে অন্য সঙ্গী দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। পরবর্তীতে জানা যায় তিনি আসলে একজন রোগীর দালাল। বিভিন্ন স্থান থেকে রোগী ধরে ডায়াগনস্টিক সেন্টার গুলোতে নিয়ে যাওয়াই তাঁর কাজ। বিনিময়ে পান মোটা অংকের কমিশন। বরিশাল নগরী জুড়ে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় গড়ে উঠেছে শত শত ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই নেই যথাযথ কাগজপত্র ও দক্ষ লোকবল।তবে প্রতিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত আছে একাধিক দালাল। তারা দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সাধারণ রোগীদের সহায়তা করার নামে অসত্য তথ্য দিয়ে নিয়ে যায় এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার গুলোতে। আর তারপর অযথা নানা টেস্ট করার নামে হাতিয়ে নেয় হাজার হাজার টাকা।প্রশাসন এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযান চালালেও অদৃশ্য কারণে পার পেয়ে যায় প্রতিষ্ঠানগুলো। দি মুন মেডিকেল সার্ভিসের চেয়ারম্যান পরিচয়দানকারী মোঃ হোসেন শাহীন অবশ্য পার পেয়ে যাবার রহস্য কিছুটা উন্মোচিত করলেন একটু বাদে। গতবছর (২০২০) ভূয়া ডাক্তার দিয়ে অযথা বিভিন্ন টেস্ট করানোর দায়ে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা ও কর্তৃপক্ষকে লক্ষাধিক টাকা জরিমানা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এবং একই সাথে দুই মাস জেল খাটেন মুন ডায়ানেষ্টিক‘র চেয়ারম্যান মো: হোসেন শাহিন। জেল থেকে বের হয়ে রহস্যজনকভাবে আবার চালু হয় প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে সেখানে ইসিজি ও আল্ট্রাসোনোগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ টেস্টগুলো করেন তামান্না আহমেদ সাইফা ও সুমাইয়া আখতার মীম নামের দুজন তরুণী কিন্তু তারা কেউই উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরুতে পারে নি। আর দক্ষ টেকনোলজিস্ট ছাড়া রোগ নির্ণয় পরীক্ষা ও টেস্ট করা সম্পূর্ণ বেআইনি। তবে মোঃ হোসেন শাহীন জানান, দক্ষ টোকনোলোজিস্ট রাখা অনেক খরচ। প্রতিষ্ঠানের খরচ কমাতেই অদক্ষ লোক রাখা হয়েছে। আর এভাবে খরচ কমিয়ে লাভের একটা অংশ তিনি উপঢৌকন হিসেবে দেন স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতাকে। যার বদৌলতে সিলগালা করা প্রতিষ্ঠানটির কোন বৈধ কাগজপত্র না থাকলেও পুনরায় চালাচ্ছেন পূর্ণ প্রতাপে। নগরী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোগীর দালালেরাও নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে শাহীনকে সহায়তা করছে রোগী সরবরাহ করে। বিভিন্ন ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে রোগী সরবরাহ করে অযথা টেস্ট করিয়ে অতিরিক্ত কমিশন আদায় করে নেয়া এসব দালালের দৌরাত্ম নগরী জুড়েই। যা বিভিন্ন সূত্রে ও সরেজমিনে অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে। কোন রোগী নির্দিষ্ট ডাক্তার দেখাতে বরিশালে এলেও এসব দালালের খপ্পরে পরে দারস্থ হন ভূয়া ডাক্তারের। যাদের পরামর্শে নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে হতে হয় সর্বশান্ত। আগরপুর রোডের চেয়েও সদর রোডস্থ বাটার গলি এলাকায় এসব দালালেরা চোখেপরে আরো বেশি।কারণ সেখানে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বার সংখ্যাও বেশি। অনেক সময় যে সকল রোগী ডাক্তার দেখাতে বিভিন্ন স্থান থেকে নগরীতে আসে সেকল রোগীদের দেখেই দাললরা টার্গেট করে। এবং সহায়তার নামে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সাথে কথা বলিয়ে দেয়ার কথা বলে আগে থেকেই সেট করা এক দালাল পরিচিত অপর দালালকে স্যার সম্মোধন করে রোগীর সামনে বসেই ফোন করে জানতে চান “স্যার আপনি কোথায় আছেন? আপনার একজন রোগী আসছে তার সাথে কথা বলেন। অপর প্রান্তের ঐ দালাল পূর্বপরিকল্পিতভাবে সাজোনো গল্পের ন্যায়ে বলেন “আমি বরিশালের বাহিরে আছি, আপনি অমুক ডাক্তারকে দেখান, সে খুবই ভালো চিকিৎসা দিবে। তখন ফোনে ধরিয়ে দেয়া ঐ দালাল রোগীকে মুন ডায়াগনোস্টিক‘র ভূয়া ডাক্তার মো: হোসেন শাহিনকে ফোনে ধরিয়ে দেয়। আর এতে করেই খপ্পরে পড়ে যায় সাধারণ রোগীরা। কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, বাটার গলির দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত হয় দি মুন মেডিকেল সার্ভিসের চেয়ারম্যান খ্যাত শাহীন ও অন্য তিন সহোদরের মাধ্যমে। এই তিন সহোদর হচ্ছে, জনৈক নুরুল ইসলামের তিন পুত্র সাদ্দাম, ইমন ও সুমন। এই সহোদরদের সঙ্গে সমন্বয় করে রোগী ধরার কাজ করেন স্বপন, বাদল, আল- আমীন, মিজান ও জাহাঙ্গীর। এদের মধ্যে বাদল, আল – আমীন ও জাহাঙ্গীর গত সপ্তাহে পুলিশের হাতে আটক হন রোগীদের ভুল তথ্য দিয়ে অতিরিক্ত টেস্ট করিয়ে হয়রানি করার অপরাধে।তবে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে শাহীন ও উক্ত তিন সহোদরেরা আটককৃত এসব দালালদের ছাড়িয়ে এনেছেন। এই দালাল সিন্ডিকেটগুলোর মূল কাজ গ্রাম থেকে চিকিৎসার প্রয়োজনে আসা বিভিন্ন রোগীদের সহায়তার নামে জিম্মি করা। পরবর্তীতে সিন্ডিকেটের নির্ধারিত চিকিৎসক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে হাতিয়ে নেয়া কমিশন। এসব দালাল আর ভূয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর দৌরাত্ম্য বিপাকে পরে চিকিৎসা নিতে আসা অসহায় রোগী ও তাদের স্বজনেরা। তবে দালালদের রুখতে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। এবং রোগীর দাললদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
Leave a Reply