বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ২০ মে থেকে শুরু হওয়া ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় প্রায় ২০ হাজার জেলে পরিবারে প্রচন্ড অভাবের ধকল চলছে। একেতো পর্যটন এলাকা কলাপাড়ার কুয়াকাটা পহেলা এপ্রিল থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একারণে অন্তত পাঁচ হাজার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার শ্রমজীবী আগেই বেকার হয়ে আছে। তার উপরে সমুদ্রগামী জেলেদের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞার ধকল আরেকদফা বিপদগ্রস্ত করে ফেলেছে। মৎস্য বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের বংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত মোট ৬৫ দিন পর্যন্ত সব ধরনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। কলাপাড়ায় যদিও কার্ডধারী নিবন্ধিত জেলের সংখ্য ১৮ হাজার তিন শ’ পাঁচ জন। প্রকৃতপক্ষে এর সংখ্যা আরও বেশি। যদিও নিষেধাজ্ঞাকালীন সময় প্রত্যেক কার্ডধারী জেলে পরিবারকে দুই কিস্তিতে ৮৬ কেজি করে চাল দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই তালিকা নিয়ে জেলেদের রয়েছে অন্তহীন অভিযোগ। কার্ডধারী এক চতুর্থাংশ জেলে ভুয়া। অন্য পেশার লোক। আর প্রকৃত জেলেরা শত শত বাদ পড়েছেন। বেকার হওয়া কিছু জেলে ট্রলার ও জাল মালিকের ছেড়া জাল সেলাই করছেন। বাকি জেলেরা বেকার হয়ে আছেন। আগে কিছু জেলেরা মাটি কাটার কাজ করতে পারতেন। কিন্তু এখন প্রযুক্তির বদৌলতে মাটি কাটা চলে স্কেভেটর (বেকু) মেশিনে। অভাবগ্রস্ত জেলেরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। তারপরও যেসব জেলেদেও অন্তত কার্ড রয়েছে তারাতো কিছু না কিছু চাল পাবেন। কিন্তু প্রকৃত শত শত জেলে রয়েছেন যারা নিবন্ধিত নন তাদের তো কোন উপায় নেই। মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ। ২০১৫ সালে এই নিষেধাজ্ঞা চালু হয়। শুরুতে শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এর আওতায় থাকলেও ২০১৯ সালে সব ধরনের নৌযানকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়। জেলেরা এই সময়ে জীবিকার প্রশ্নে সমস্যায় পড়েন। কর্মহীন অবস্থায় চরম দুরাবস্থায় কাটছে তাঁদের দিন। উপজেলার ৪০টি জেলে গ্রামের সব ক’টির চিত্র এক। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে, আলীপুর ,মহিপুর, লালুয়া, কুয়াকাটা, ধুলাসার, ধানখালী, বাবলাতলার ঢোস, নিজামপুর, গঙ্গামতির জেলেরা। জেলেদের অভিযোগ ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের জেলে তালিকায় অর্ন্তভুক্ত মৎস্য শিকারিদের (ভিজিএফ) খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করেছে সরকার। দীর্ঘ এ সময়ে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ জেলে পেশা পরিবর্তণ করে ভিন্ন পেশায় ঝুঁকেছেন। তবে তালিকা হালনাগাদ না হওয়ায় বর্তমানে সরকারের প্রদেয় এই সুবিধা থেকে ছিটকে পড়েছেন সত্যিকারের জেলেরা। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ৬৫ দিন দরকার আছে কি না, তা বৈজ্ঞানিকভাবে বিচার–বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। কারণ, প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ১৫ এপ্রিল থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত। দেশে এই সময়সীমা ১ মে থেকে ৩০ জুন করা হলে তা বেশি কার্যকর হতে পারে। গঙ্গামতির জেলে আবুল হোসেন বলেন, ‘করোনায় মোগো মেরুদন্ড ভাইঙা ফেলছে। আবার পর ২২ দিনের ইলিশের অবরোধ (নিষেধাজ্ঞা), ৮ মাসের জাটকা ধরার অবরোধ। এখন গাঙ্গে-সাগরেও তেমন মাছ-পোনা নাই। এহন আবার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা। ক্যামনে যে বউ-বাচ্চা লইয়্যা বাঁচমু, কইতে পারি না!’ চাড়িপাড়া গ্রামের জেলে আবু জাফর জানান, এই এলাকার ৯০ শতাংশ মানুষ মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এখন তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে কষ্ট হচ্ছে। ‘সাগরে ইলিশ শিকার বন্ধ। আয়ের পথও বন্ধ রয়েছে। তবে এসব জেলেরা জানান, ট্রলারের নামসহ মাছ আহরণের সঙ্গে জড়িত জেলেদের নাম ঠিকানা নতুন করে সংগহ করে চাল বিতরণ করা প্রয়োজন। কারণ কুয়াকাটায় সাগরে অগভীর এলাকায় রয়েছে কয়েক হাজার খুটা জেলে। আর বিভিন্ন ইউনিয়নে রয়েছে গভীর সমুদ্রগামী জেলে। এদের তালিকা নবায়ন করা জরুরি। নইলে সরকার জেলেদের খাদ্য সহায়তা দিলেও এক চতুর্থাংশ অপেশাদারী লোকজন নিয়ে যাচ্ছেন। মহিপুর মৎস্য বন্দরের মৎস্য আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি মো. ফজলু গাজী বলেন ‘দক্ষিণের এ মৎস্য বন্দরে প্রায় লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। মৎস্য ভিত্তিক অর্থনীতি সুরক্ষায় জেলেদের পেশা পরিবর্তন রোধে খাদ্য সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধিসহ আর্থিক সহায়তা প্রদান এখন সময়ের দাবি।’ আলীপুর ট্রলার মালিক ও মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘শুরু থেকেই ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পুনর্র্নিধারণের দাবি জানিয়ে আসছেন ব্যবসায়ী ও জেলেরা। ভারতে এই নিষেধাজ্ঞা ৪৫ দিনের। শুরু হয় ১৫ এপ্রিল থেকে। তাই ভারতের সঙ্গে মিল রেখে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা নির্ধারণ করা হলে তা বেশি কার্যকর হবে।’ বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদফতরের সাসটেইনেবল কোস্টাল এ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, শুধু ইলিশ নয়। বঙ্গোপসাগরে ৪৩৫ প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে, যা সংরক্ষণ ও নির্বিঘ্ন প্রজননের স্বার্থে এবং সমুদ্রনির্ভরশীল অর্থনীতির লাগসই উৎপাদন ও বাস্তবায়নের নিমিত্তে সরকার বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় নিরঙ্কুশ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬৫ দিনের জন্য সব ধরনের মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ করেছে। তালিকা যাচাই-বাছাই প্রসঙ্গে সিনিয়র কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই কাজটি শুরু করা হবে।
Leave a Reply