দখিনের খবর ডেক্স ॥ করোনাকালে নারীর ওপর নির্যাতন ও কাজের চাপ বেড়েছে। ব্র্যাক ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পৃথক দুই জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক অনিরাপত্তাবোধ, পেশাগত অনিশ্চয়তা ও দীর্ঘসময় ঘরে বন্দিত্বের কারণে নির্যাতনের পরিমাণ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন জরিপে উত্তরদাতারা। সংস্থাগুলোর ফোকাস গ্রুপ আলোচনায়ও বেরিয়ে আসছে একই তথ্য। গবেষক ও নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, যারা নির্যাতনকারী তাদের কাছে পরিস্থিতি কোনও ব্যাপার নয়। ব্যাপার হচ্ছে নারী বা শিশু, যাদের সে নির্যাতন করবে, তারা কতটা হাতের কাছে রয়েছে। ফলে একদিকে সে তার জীবন কীভাবে টেকাবে সেই শঙ্কা, আরেকদিকে অজানা এক ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়। এই দুই মিলিয়ে সে হয়ে উঠছে নির্যাতনকারী।
প্রশ্ন উঠতে পারে কোন পরিস্থিতিতে ঘরে আবদ্ধ নারীর ওপর পুরুষরা নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো? জরিপে বেরিয়ে এসেছে গৃহবন্দিত্বকালের এই সময়ে নারীরা দীর্ঘ সময় তার অত্যাচারীর কাছাকাছি থাকে। তারা চাইলেই বাসা থেকে বের হয়ে যেতে পারছেন না, পারছেন না কারও কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতে। যে কারণে বেড়েছে নির্যাতনের হার।
সম্প্রতি কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে নারীর অবস্থা কী সেটি নিয়ে জরিপ করে উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। ব্র্যাকের পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুসারে ৯১ শতাংশ নারী বলছেন, বাসায় কাজের চাপ বেড়েছে। ৮৯ ভাগ নারী বলছেন অবসর সময় বলে কিছু নেই। সারা দিন ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। গৃহস্থালি কাজ, বয়স্কদের সেবাযতœ, ছোটদের খেয়াল রাখাসহ যারা সচরাচর বাসায় থাকেন না তাদেরও পুরো সময় দেখভাল করতে গিয়ে নিজের সময় বলে কিছু থাকছে না। তৃণমূল থেকে নেওয়া তথ্য বলছে এসময়কালে ৭৬২টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতার শিকার ৯১ ভাগ নারী ও কন্যাশিশু। ৮৫ ভাগ নির্যাতনকারী ঘরের মধ্যেই থাকে।
পারিবারিক নির্যাতনের কারণ; ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কেবল ঢাকা সিটিতে নয়টি ধর্ষণ, আটটি যৌতুক দাবি, ৬টা যৌন হয়রানি, এবং ৫টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। ৩২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে পারিবারিক নির্যাতনের প্রবণতা বেড়েছে। ২৮ শতাংশ নারী ও ২২ শতাংশ পুরুষ উত্তরদাতা পারিবারিক নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার পক্ষে উত্তর দিয়েছে। ৭৫ শতাংশ বলছেন, চাকরি হারানোর শঙ্কা তাদের হতাশাগ্রস্ত করায় নির্যাতনের এই প্রবণতা বেড়েছে। ৫৭ শতাংশ বলছে কোনও আয় ছাড়া দীর্ঘ সময় গৃহবন্দি থাকায় অনিশ্চয়তা বেড়ে গেছে বলে এ ধরনের নির্যাতনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। ৩৮ শতাংশ মনে করেন, পর্যাপ্ত খাবার না থাকা অন্যতম কারণ।
বাল্যবিবাহ বেড়েছে; ৮৫ শতাংশ বাল্যবিবাহ ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক অনিরাপত্তার জায়গা থেকে দেওয়া হয়েছে। ৭১ শতাংশ স্কুলের অনিশ্চয়তায় এবং ৬১ শতাংশ বিদেশি ও ভালো পাত্র সহজে পাওয়ায় মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। ফোকাস গ্রুপ আলোচনায় বেরিয়ে আসে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরুষ বিশেষত স্বামীরা অনিরাপত্তাবোধ, মানসিক চাপে থাকায় স্ত্রীদের প্রতি নির্যাতন বেড়েছে। মানসিক টানাপড়েনের কারণ; ব্র্যাকের জরিপ অনুযায়ী, ৭৫ শতাংশ উত্তরদাতা আয় নিয়ে চিন্তিত, ৪৮ শতাংশ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, ৫২ শতাংশ দীর্ঘসময় ঘরে বন্দি থাকা নিয়ে চিন্তিত, ৩৯ শতাংশ সন্তানের শিক্ষা নিয়ে চিন্তিত।
জরিপে মার্চের ২৬ থেকে ৯ এপ্রিলের মধ্যে ৫৫৭ জনের কাছ থেকে উত্তর নেওয়া হয়েছে। ১১টা জেলার ওপরে এই জরিপ করা হয়েছে উল্লেখ করে ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস ডাইভার্সিটি প্রকল্পের পরিচালক আনা মিনস বলেন, শুরু থেকেই আমরা বিশ্বের নানা জায়গা থেকে নারী নির্যাতনের খবর পাচ্ছিলাম। সেক্ষেত্রে আমাদের নারীরা কেমন আছে সেটা জানতে চেষ্টা করেই এই জরিপ। আমরা কোভিড ১৯ নিয়ে সচেতনতার কাজ করছিলাম। তারই সঙ্গে দশটি নির্যাতনকেন্দ্রিক প্রশ্ন জেনে নেওয়ার কাজ করা হয়। আমাদের জরিপ ফলাফল যেমন বলেছে নারী নির্যাতন বেড়েছে ঠিক তেমনই ফোকাস গ্রুপ আলোচনাতেও একই বিষয়গুলো এসেছে।
নারী অধিকারকর্মী প্রধান শাহানা হুদা বলেন, করোনাভাইরাস মহামারিতে সারা বিশ্বের মানুষ যখন শুধু বেঁচে থাকা নিয়ে আতঙ্কিত, এই পরিস্থিতিতেও চলছে নারীর ওপর সীমাহীন নির্যাতন। সারা বিশ্বে পারিবারিক সহিংসতা অনেক বেড়ে গেছে এবং চরম অনিরাপত্তায় ভুগছে নারীরা। এই লকডাউন পরিস্থিতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে গৃহে আবদ্ধ থাকা নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে। গৃহবন্দিত্বকালের এই সময়ে নারী অত্যাচারীর কাছাকাছি থাকতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকটা সময়। তারা চাইলেই বাসা থেকে বের হয়ে যেতে পারছেন না, পারছেন না কারো কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতে। এসময়টাতে পুলিশ, হাসপাতাল সবাই করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যস্ত। আপৎকালীন সময়ে অপরাধীরা মানুষের এই দুর্বলতা, অমনোযোগিতা এবং ঘরবন্দি হওয়ার পরিস্থিতিকে কাজে লাগায়। দুঃসময়ে গৃহ একজন নারী বা শিশুর কাছে সবচেয়ে নিরাপদ হওয়ার কথা। কিন্তু মহামারির সময়কার এই সামাজিক দূরত্বকে পুঁজি করে নারীর ওপর অত্যাচারের হার বাড়িয়ে দিয়েছে পুরুষ ।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নারীর প্রতি সহিংসতা প্রকল্পের সমন্বয়ক অর্পিতা দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করছেন তাদের পর্যবেক্ষণ, ভায়োলেন্স বেড়ে গেছে। লম্বা সময় পুরুষ সদস্যরা ঘরে থাকছেন। দিনমজুর বা ছোট ব্যবসায়ী যারা বসে আছে, তাদের সামনে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসবের মধ্যে পুরুষ তার স্ত্রীর প্রতি অমানবিক হয়ে উঠছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘরের শিশুর ক্ষেত্রেও। আমরা আগামী ৬ তারিখ আমাদের জরিপের বিস্তারিত তুলে ধরবো। এমনকি এই তথ্য নিতে গিয়ে আমরা গৃহকর্তার বাধার সম্মুখীনও হয়েছি। জরিপের উত্তর ফোনে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, মার্চের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত কাজটি করা হয়েছে। আগামীতেও এটা অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, যাদের নিয়ে আমরা কাজ করি তারা যেন এই সময়টাতে নিজেদের বিচ্ছিন্ন না ভাবে। আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, এই সময়টাতে বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে। আমরা রিপোর্ট প্রকাশের সময় সংখ্যাটি জানাবো।
Leave a Reply