গৌরনদী প্রতিনিধি ॥ বরিশালের গৌরনদীতে স্বামীর হাতে হত্যাকান্ডের শিকার বগুড়া সদর থানার তরুনী নাজনীন আক্তার (২৪) এর লাশর্ একটি ফসলের ক্ষেতের পানিতে বস্তাভতি ভাসমান অবস্থায় বুধবার সকালে উদ্ধার করা হয়েছে। লোকমুখে খবর পেয়ে পুলিশ হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল থেকে কোয়াটার কিলোমিটার পূর্বদিকের বাটাজোর ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন একটি বিলের ফসলের ক্ষেত থেকে লাশটি উদ্ধার করে। ওই তরুনীকে প্রতারনামূলক বিয়ে করার পর গত ২৪ মে গৌরনদীতে এনে হত্যার পর লাশ গুম করেছে তার স্বামী বগুড়া সেনানিবাসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী সাকিব হোসেন (২৪)। নিহত তরুনীর স্বজনদের দেয়া বর্ননা সূত্রে জানাগেছে, বগুড়া সদর থানার সাবগ্রাম উত্তরপাড়া এলাকার মুদি ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ প্রামানিক এর কন্যা নাজনীন আক্তার (২৪) এর সাথে প্রায় দুই বছর পূর্বে ফেইসবুকে পরিচয় হয় বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর ইউনিয়নের চর উত্তর ভূতেরদিয়া এলাকার নতুন জাহাপুর গ্রামের ভ্যানরিক্সা চালক আব্দুল করিম হাওলাদারের ছেলে ও বগুড়া সেনানিবাসে কর্মরত পরিচ্ছন্নতাকর্মী সাকিব হোসেনের। এ পরিচয়ের এক পর্যায়ে পরিবারের সদস্য ও সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানিয়ে গত ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সাকিব নাজনীনকে গোপনে বিয়ে করে। এ সময় সাকিব নাজনীন ও তার পরিবারকে জানায় তার বাবা বড় ব্যবসায়ী, তাদের চারতলা বাড়ি আছে। বিয়ের সময় প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সাকিব তাদের বিয়ের কাবিননামায়ও ভূল নাম এবং ভূয়া ঠিকানা ব্যাবহার করে। বিবাহিত জীবনের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাদের মধ্যে কলহ বাধে। এ কলহের এক পর্যায়ে গত ২৪মে বেলা ১১টার দিকে সাকিব নাজনীনকে ফোন করে বলে আমার বাবা খুব অসুস্থ্য, বাড়িতে যেতে হবে। আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বগুড়ার গোদাগড়া চারমাথা বাসষ্ট্যান্ডে আসছি, তুমি ওখানে আসো। তোমাকে আমি সাথে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাব। নাজনীনের ভাই আহাদ তখন ওই বাসষ্ট্যান্ডে নিয়ে গিয়ে নাজনীনকে সাকিবের হাতে তুলে দেয়। ওই দিন রাত থেকে তারা নাজনীন ও সাকিবের মোবাইল বন্ধ পায়। এরপর তারা সাকিবের মায়ের মোবাইলে ফোন দেয়। ওই ফোনটি বাজলেও কেউ রিসিভ করেনি। ঘটনার দুইদিন পর সাকিব ফোন করে নাজনীনের বাবাকে বলে আপনার মেয়ে পালিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই আপনার কাছে গেছে আমার স্ত্রীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। পরে এ ঘটনা নাজনীনের পিতা আব্দুল লতিফ প্রামানিক বাদি হয়ে গত ২৬ মে বগুড়া সদর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এরপর তিনি বগুড়া সেনানিবাসের উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদেরকে ঘটনা অবহিত করেন। তারা তখন সাকিবের ছুটি বাতিল করে তাকে ২৮শে মে’র মধ্যে তাকে কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেয়। নির্দেশ পেয়ে সাকিব ২৮শে মে তার কর্মস্থলে যোগদান করে। পরে সেনাকর্মকতাদের জিজ্ঞাসাবাদে নাজনীন খুনের ঘটনা বেড়িয়ে আসে। সেনাকর্তৃপক্ষ তখন সাকিবকে সাময়িক বরখাস্ত করে বগুড়া সদর থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়। হত্যার দ্বায় স্বীকার করে সাকিব হোসেন জানান, ফেইসবুকে পরিচয় ও প্রেমের এক পর্যায়ে সে নাজনীনের সাথে দেখা করতে গেলে নাজনীনের স্বজনরা তাকে আটকে ফেলে জোর পূর্বক তার সাথে নাজনীনকে বিয়ে দেয়। এ ঘটনায় সে নাজনীন ও তার পরিবারের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। নাজনীনকে নিয়ে ২৪শে মে সকালে বগুড়া থেকে বাসযোগে রওনা হয়ে সে ওইদিন রাত ১০টার দিকে গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর বন্দর সংলগ্ন হরহর গ্রামের মোঃ সালাউদ্দিন বেপারীর ভাড়া দেয়া টিনের ঘরে তার ভ্যানরিক্সা চালক বাবার ভাড়া বাসায় ওঠে। সাকিবের এ দরিদ্র অবস্থা দেখে এ সময় নাজনীন ক্ষিপ্ত হয়। তার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে নাজনীন সাকিবকে তখন গালীগালাজ করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এক পর্যায়ে সাকিব ওইদিন রাত ১১টার দিকে একটি লাইলন দড়ি দিয়ে নাজনীনের পেছন থেকে গলায় প্যাচ মেরে তাকে বিছানায় ওপর ফেলে দেয়। এরপর সে বালিশ চাঁপা দিয়ে নাজনীনকে হত্যা করে। এরপর রাত দেড়টার দিকে সে নাজনীনের লাশ ওই বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্কের মধ্যে ফেলে দেয়। সাকিবের দেয়া বর্ননা মতে সেপটিক ট্যাংকির ভেতর থেকে নাজনীনের লাশ উদ্ধারের জন্য বগুড়া সদর থানার ওসি (তদন্ত) মোঃ আবুল কালাম আজাদ, এসআই মোঃ গোলাম মোস্তফা, এএসআই মোঃ উজ্জল হোসেন সঙ্গীয় ফোর্সসহ হত্যাকারী সাকিবকে সঙ্গে নিয়ে সোমবার রাতে গৌরনদী মডেল থানায় এসে পৌছেন। এরপর গৌরনদী মডেল থানা পুলিশের সহয়তায় তারা মঙ্গলবার ভোরে লাশ উদ্ধারে অভিযানে নামেন। সাকিবের দেয়া বর্ননা মতে পুলিশ মঙ্গলবার সকালে সেপটিক ট্যাংকির পানি সেচ করে। কিন্তু সেখানে কোন লাশ পাওয়া যায়নি। তবে ট্যাংকির ভেতর থেকে এ সময় নাজনীনের হাতের চামড়ার কিছু অংশ, হাতের আঙ্গুলের দুটি নখ ও একটি ওড়না উদ্ধার করে। এর পর পুলিশ হন্যে হয়ে দিনভর হত্যাকান্ডস্থলের আশপাশের এলাকা চসে বেড়ায়। কিন্তু তারা নাজনীনের লাশের কোন সন্ধান করতে পারেনি। বুধবার সকাল ১০টার দিকে হত্যাকান্ডস্থল থেকে কোয়াটার কিলোমিটার পূর্বদিকের বাটাজোর ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন বর্ষার পানিতে ডোবা বিলের একটি ফসলের ক্ষেতে ট্রাক্টর দিয়ে চাষ শুরু করেন উপজেলার দক্ষিন বাটাজোর গ্রামের আবুল কালাম আকনের ছেলে মোঃ তাজেল আকন ওরফে দুঃখু মিয়া (২৮)। এ সময় পার্শ্ববর্তি জমির পানিতে ভাসমান একটি বস্তাথেকে দুর্গন্ধ পেয়ে সে এলাকার প্রভাবশালীদের খবর দেয়। খবর পেয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা দিলু হাওলাদার তার কয়েকজন সহযোগী নিয়ে সেখানে পৌছে বস্তাভর্তি ভাসমান অবস্থায় একজন নারীর লাশ দেখতে পেয়ে থানা পুলিশকে খবর দেয়। খবর পেয়ে গৌরনদী মডেল থানার ওসি মোঃ আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ বুধবার দুপুর ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌছে লাশটি উদ্ধার করে। গৌরনদী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ আফজাল হোসেন জানান, লোকমুখে খবর পেয়ে তারা লাশটি উদ্ধার করেছেন। এটা নাজনীনের লাশ কিনা তা সনাক্ত করতে তার স্বজনদেরকে খবর দেয়া হয়েছে। তারা বগুড়া থেকে রওনা হয়েছেন। তারা এসে সনাক্ত করলেই পুলিশ নিশ্চিত হতে পারবে যে, এটি নাজনীনের লাশ। তবে আমরা ধারনা করছি লাশটি নাজনীনেরই।
Leave a Reply