সোহেল সানি ॥ রাজনীতিতে উত্থান পতনের এক অনবদমিত চরিত্র মোহাম্মদ নাসিম। বিশ্বজুড়ে হায়েনা নামক করোনার মৃত্যুর থাবায় যখন লাখো লাখো প্রাণের সংহার, ঠিক তখনই হাসপাতালে শয্যাশায়ী বাংলাদেশের রাজনীতির সিংহপুরুষ মোহাম্মদ নাসিম। গণমাধ্যমে তাঁর ব্রেইন স্ট্রোকের খবরে হতভম্ব বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা। দোয়া প্রার্থনা আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের।
রাজনীতিতে উত্থান পতনের সম্মুখীন হওয়া মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে আমার সুগভীর ঘনিষ্ঠতা মূলত তিন দশকেরও অধিক সময় ধরে ‘রাজনীতির কিং মেকার’ বলে পরিচিতি সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু’ ভাইয়ের বদৌলতে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মহাবিপর্যয়ের পর প্রায় সব সিনিয়র নেতা রাজনীতির ময়দানে দায়সারা গোছের অবস্থান গ্রহণ করেন। বর্ষীয়ান জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদের অতি স্নেহসান্নিধ্যলাভের সুবাদে আওয়ামী লীগের ভেতরের খবরগুলো অতি সহজেই আমার জানার সুযোগ হতো। বলতে গেলে সার্বক্ষনিক আমি প্রিয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের সঙ্গী তখন। আওয়ামী লীগ প্রধান ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার তখনও আমি স্নেহান্ধ। তিনি আমাকে আওয়ামী লীগের প্রথম উপকমিটিতে ঠাঁই দিলে শীর্ষ নেতাদের কাছেও অনেকটা প্রিয় হয়ে উঠি।
২০০২ সালের ২০ জুন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা সেসময়কার ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলীয় নীতিনির্ধারণী বিষয়ে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকাকে একটি সাক্ষাতকার দেন। অহঙ্কার করছি না, আমাকে দেয়া ওই সাক্ষাতকারটিই ছিলো, বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালীন একমাত্র সাক্ষাতকার। ওই সময়ে মাননীয় নেত্রীর মুখে দলের অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয়ই আমার শোনার সৌভাগ্য হয়। বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ১৯৯৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ হতে বহিস্কৃত হন আমাকে দেয়া একটি সাক্ষাতকারকে কেন্দ্র করে। দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ওই সাক্ষাতকারটির শিরোনাম ছিলো, “পার্বত্য শান্তি চুক্তির নামে শেখ হাসিনা ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দিয়েছেন।” ওই সময় হতেই আমি মূলত মাননীয় শেখ হাসিনার স্নেহধন্য হয়ে উঠি। যাহোক ফিরে আসি ২০০২ সালের কথায়।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি আমাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর দিলেন, বললেন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সাধারণ সম্পাদক পদে আর আমি থাকছি না। আমার প্রশ্ন ছিলো, তাহলে আব্দুল জলিল নাকি মোহাম্মদ নাসিম? জিল্লুর রহমান বলছিলেন, মোহাম্মদ নাসিম কমিটিতেই থাকতে পারবে বলে মনে হয় না, তাঁর ওপর সভানেত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ। তাহলে জলিল ভাই…. আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের উত্তর ছিলো, তোমাকে তো সভানেত্রী সাক্ষাতকার দিয়েছেন, তাঁর কাছে কেনো জানতে চাইলে না পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক কে? তবে আব্দুস সামাদ আজাদ ওই সময়ে আওয়ামী লীগ প্রধানের সবচেয়ে বিশ্বস্তভাজন। তিনি আমাকে আগেই বলেন আবদুল জলিল হবে দলের সাধারণ সম্পাদক। কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণা হলো। তখন জিল্লুর রহমানের মন ভীষণ অস্থির ছিলো। আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী বেগম আইভি রহমান। শেষ দিকে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তাঁকে ডাকা হতো না মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বেগম আইভি রহমানকে। জিল্লুর রহমানের সেই অস্থিরতার প্রকাশও একদিন করলেন খুব দুঃখ ভারাক্রান্ত ভাষায়। সেই কথাগুলো আমি বলছি না প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবশতঃ
তিনি রাষ্ট্রপতি পদে শপথ গ্রহণের পরপরই দরবার হলে বসেই আমার অকৃত্রিম বন্ধু বর্তমান বিএফইউজে’র মহাসচিব শাবান মাহামুদকে বলেন, “সোহেল সানি কৈ? ওকে আমার এপিএস করবো, ওকে দ্রুত খবর দাও।” আমি এপিএস কেনো হয়নি সে নিয়ে এ লেখায় কিছু উল্লেখ করছি না, তবে শুধু বলবো রাষ্ট্রপতি হওয়ার বড় স্বপ্ন ছিলো আমার প্রিয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের। তিনি প্রায়শঃই বলতেন, সোহেল সানি আমি রাষ্ট্রপতি হলে তুমি বঙ্গভবনে বসে কাজ করবে। জানিনা তিনি বেঁচে থাকলে রাষ্ট্রপতি হতেন কিনা, তবে জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তাঁর চেহারা আমার চোখের আয়নায় ভেসে ওঠে। যাক
ফিরে আসি মোহাম্মদ নাসিম প্রসঙ্গে। জিল্লুর রহমানের কথার ভিত্তিতে আমি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের ছয় দিন আগে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় ” মোহাম্মদ নাসিম পদ হারাচ্ছেন” শিরোনামে একটি রিপোর্ট করলাম। নাসিম ভাই রিপোর্ট পড়ে শুধু বলেছিলেন, “ভালো খবর দিয়েছো, চালিয়ে যাও।” কাউন্সিলে সত্যি সত্যিই নক্ষত্রের পতন ঘটলো। আব্দুল জলিল সাধারণ সম্পাদক হলে মোহাম্মদ নাসিম প্রেসিডিয়াম সদস্য হবেন এমনটাই ধারণা ছিলো সর্ব মহলের। আমার রিপোর্টেরও গুরুত্ব ছিলো না। মোহাম্মদ নাসিমের প্রশ্নে আব্দুস সামাদ আজাদ বিশিষ্ট ভুমিকা রাখেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে এক নম্বর সদস্য করা হয়। মোহাম্মদ নাসিম নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়ার পর বলেছিলেন, “বাবা যেমন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করে জীবন দিয়েছেন দরকার হলে আমিও শেখ হাসিনার জন্য জীবন দিবো বিশ্বাসঘাতকতা করবো না।” বীর তেজস্বী নেতার চোখে সেদিনের অশ্রুজলপ্রপাতের দৃশ্য আমার চোখকে ঝাপসা করে দিচ্ছে। নাসিম ভাই ওয়ান ইলেভেনের কারণে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। পুত্র তানভীর শাকিল জয় তাঁর আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। ২০০৯ সালের কাউন্সিলে সগৌরবে ফিরে আসেন নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামে। পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন। তিনি আমাকে এতটাই স্নেহ করেন যে, যে কোনো একটি মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর সামনে হাজির হওয়া মাত্র স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে (বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) রেড টেলিফোনে আমার বিষয়টি দেখার জন্য যে স্নেহপ্রীতি প্রদর্শন করেন, তার প্রতিদান আমি কোনকিছুর বিনিময়েই দিতে পারবো না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে সেই সূত্র ধরে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালের ১৫ মার্চ। মোহাম্মদ নাসিমের বাসায় গিয়ে হাজির হই। তিনি একটি সাক্ষাতকার দেন। ওই সাক্ষাতকারটি বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম কলামে প্রকাশিত হয়। আজ মোহাম্মদ নাসিম যখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তখন ওই কথাগুলোই মনে পড়ছে। বর্ষীয়ান জননেতা আমির হোসেন আমু’র সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল, জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা মোহাম্মদ নাসিমের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে। আমির হোসেন আমু অত্যন্ত ভাবগম্ভীর কন্ঠে মোহাম্মদ নাসিমের দৃঢ়চেতা চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করে বলছিলেন, আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রকাশ্যে মোহাম্মদ নাসিম হলো এক সাহসী ও সোচ্চার কন্ঠ। রাত সাড়ে দশটার দিকে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ভারাক্রান্ত কন্ঠে জানালেন, মনটা ভালো নেই, নাসিম ভাইকে নিয়ে। জানিনা ভাগ্যে কি লেখা আছে তাঁর। এর পরপরই মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে লিখতে বসি। টিভিতে প্রচারিত খবরে তাঁর সফল অপারেশনের খবরও শুনলাম।
মোহাম্মদ নাসিম। বক্তৃতার ময়দানে যাঁর অমোঘ বজ্রকন্ঠে কর্কশ শব্দ ধ্বনি, সেই মানুষটিই আবার ঘরোয়া সান্নিধ্যে অনিন্দ্য সুন্দর মিষ্টভাষী। মোহাম্মদ নাসিম আমাদের প্রিয় নেতা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কৃপায় তিনি সুস্থ হয়ে রাজনীতির মাঠে সরব হবে সেই কামনা করছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের হাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা প্রকোষ্ঠে নিহত জাতীয় চার নেতার অন্যতম বাকশাল সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও বাকশালের মহাসচিব ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সুযোগ্য পুত্র মোহাম্মদ নাসিম।
১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে জন্ম নেয়া নাসিম ১৯৬৯ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম তিন পুত্র সন্তানের জনক। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার পর প্রথমে আত্মগোপন করলেও পরে কারারুদ্ধ হন। ১৯৮০ সালে কারামুক্ত হওয়ার পর রাজনীতিতে যুক্ত হন। আমির হোসেন আমু বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের যখন নেতৃত্বে তখন নাসিম যুবলীগের সামনের সারিতে উঠে আসেন। আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক এবং পরবর্তীতে প্রচার সম্পাদক হওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে লাইম লাইটে উঠে আসেন। ১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর বিরোধী দলের চীফ হুইপ হন। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জের দুটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমে ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী এবং পরে গণপূর্তমন্ত্রীরও দায়িত্বলাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে নিয়োজিত হন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে ইস্পাত-দৃঢ় অবস্থান তাঁর জনপ্রিয়তায় কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ১৯৯৭ সালের কাউন্সিলে দ্বিতীয়বারের মতো দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর ধারণা করা হচ্ছিল, পরবর্তী কাউন্সিলে মোহাম্মদ নাসিমই হবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর আপন সহোদর ডঃ মোহাম্মদ সেলিম ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দুটি আসনে বিজয়ী হওয়া নাসিমকে একটি আসন ছেড়ে দিতে হয়। শূন্য আসনে ডঃ মোহাম্মদ সেলিম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে নাসিম বড় ভাই ডঃ মোহাম্মদ সেলিমের আসন সহ মোট তিনটি আসনে প্রার্থি হন। ডঃ সেলিম বিদ্রোহী প্রার্থী হন। ফলে মোহাম্মদ নাসিমকে একটি আসনে বিজয় নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পারিবারিক দ্বন্দ্বের জের আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
Leave a Reply