শুরুর দিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রাজধানী ঢাকা এবং আশপাশের কয়েকটি জেলায় বিস্তার হলেও এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামে। সংক্রমণের বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সর্বশেষ ৩৭ দিনে ঢাকার বাইরে রোগী শনাক্ত বেড়েছে চার গুণেরও বেশি; শতকরা হিসাবে ৪১৬.২২ শতাংশ। খুবই অপর্যাপ্ত নমুনা পরীক্ষার কারণে সংক্রমিতদের অধিকাংশকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে করোনা সংক্রমিত হওয়ার পর ৮০তম দিনে (২৭ মে) ঢাকার বাইরে শুধু নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম জেলায় এক হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল। ওইদিন পর্যন্ত ৬ জেলার প্রত্যেকটিতে ৫০০-র অধিক রোগী শনাক্ত হয়। গত ৩ জুলাই সংক্রমণের ১২৭তম দিনে ৩৪ জেলার প্রত্যেকটিতে ৫০০-র বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। এক হাজারেরও বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৬ জেলার প্রত্যেকটিতে।
তথ্য বিশ্লেষণে আরও পাওয়া গেছে, প্রথম ৮০ দিনে ঢাকার বাইরে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৫৫৯ জন। আর ১২৭তম দিনে ঢাকা শহরের বাইরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৮৩২ জনে। অর্থাৎ পরবর্তী ৩৭ দিনে ঢাকার বাইরে সংক্রমণ বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। শতকরা হিসেবে শনাক্ত রোগী বেড়েছে ৪১৬ দশমিক ২২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মে মাসের শেষের দিকে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যায় মানুষ। ঈদ শেষে ঢাকায় ফিরে এসেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তা ছাড়া গার্মেন্টস, মার্কেট, গণপরিবহন এবং দূরপাল্লার পরিবহন চলাচলে বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার পর গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি
দিন দিন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এখন মানুষের চলাচলে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ নেই। রোগী শনাক্ত, আইসোলেশন এবং চিকিৎসায় স্বাস্থ্য বিভাগ তেমন উদ্যোগী হচ্ছে না। কেউ নিজে থেকে পরীক্ষা না করালে শনাক্ত হচ্ছে না রোগী। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে শনাক্ত রোগীর ফলোআপ করছে না। শনাক্ত রোগী আইসোলেশনে আছেন নাকি বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেÑ এ বিষয়েও কোনো খোঁজ রাখছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। ফলে এখন শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়াচ্ছে।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, মানুষ চলাচলে এখন তো কোনো বাধা নেই। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অবাধেই যাচ্ছে মানুষ। যখন সাধারণ মানুষের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ ছিল, তখন করোনার সংক্রমণ কম ছড়িয়েছে। কিন্তু এখন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে সংক্রমিত এলাকা থেকে সংক্রমণ নেই এমন এলাকায় গিয়ে সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন। যত দিন যাচ্ছে একজনের সংস্পর্শে একাধিক লোক সংক্রমিত হচ্ছে।
করোনা রোগী শনাক্তের বিষয়ে মুশতাক হোসেন বলেন, যারা হাসপাতালে আসছেন শুধু তাদের পরীক্ষা করছি। তাদের পরীক্ষা করার পর কোনো খোঁজখবর রাখছি না। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানছে কিনা, তারা আইসোলেশনে আছে কিনা- এ বিষয়ে পরে আর খোঁজ নেওয়া হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, নিজে থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ নেওয়াÑ কারা জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনতে না পারলেও যারা জ্বরের রোগী তাদের আইসোলেশনে নেওয়া উচিত। তা হলে সংক্রমণ কমবে। আপনা-আপনি সংক্রমণ কমবে না। তা ছাড়া পরীক্ষা সংক্রমণ কমানোর কোনো ওষুধ নয়। পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমণকে চিহ্নিত করা। সুতরাং পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী শনাক্তের পর যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। পরীক্ষা বাড়ালেই সংক্রমণ কমবে না। শনাক্ত রোগীকে আইসোলেশনে নিতে হবে এবং তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই কাজটা কিন্তু এখন হচ্ছে না বললেই চলে। যারা হাসপাতালে আসছেন তারা চিকিৎসা পাচ্ছেন। আর মৃদু সংক্রমণযুক্ত রোগী হচ্ছে শতকরা ৯০ ভাগ। তারা আইসোলেশন মানছেন না। তারাই সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন।
ফরিদপুর জেলায় শুরুর দিকে সংক্রমণ খুব কম ছিল। তবে এখন ফরিদপুর জেলায় আক্রান্তের দুই হাজার ছাড়িয়েছে। এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলার সিভিল সার্জন মো. সিদ্দিকুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, সংক্রমণ বাড়ার মূল কারণ হচ্ছে ঈদের আগে থেকেই ঢাকা থেকে লোকজন আসা শুরু করে। ওই সময় থেকেই স্বাস্থ্যবিধি সাধারণ জনগণ মানছেন না। এ বিষয়ে আমরা বারবার অনুরোধ করেও সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে পারিনি। তা ছাড়া ঈদের কেনাকাটার জন্য সাধারণ মানুষ বাজারে গেছে। মূলত ওই সময় থেকেই সংক্রমণ বাড়া শুরু হয়।
ঢাকার বাইরে কুমিল্লা জেলায় সংক্রমণ এরই মধ্যে তিন হাজার ছাড়িয়েছে। এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, সংক্রমণ বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব না মানা। কুমিল্লার রাস্তায় গেলে দেখা যাবে ৪০-৫০ শতাংশ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। এখন তো কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে। এখন বাঁচার একটাই উপায় হলোÑ একজন থেকে অপরজনকে দূরে থাকতে হবে। কারণ আমরা তো সব চেষ্টাই করেছি। পুরো কুমিল্লা জেলাকে লকডাউন করেছি, জোনভিত্তিক বিভাজন করেছি। কিন্তু তাতেও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যায়নি।
ময়মনসিংহ জেলার সিভিল সার্জন ডা. এবিএম মশিউল আলম আমাদের সময়কে বলেন, শুধু ময়মনসিংহেই নয়, সারাদেশেই সংক্রমণ বেড়েছে। সারা পৃথিবীতেই সংক্রমণ শুরুর সাড়ে তিন মাস পর পিকে গিয়ে সংক্রমণ কমেছে। এখন আমরা সেই পিকে আছি। তা ছাড়া স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না। স্বাস্থ্যবিধিকে কেউই গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছেন না। আর বাংলাদেশ জনবহুল দেশ হওয়ায় সংক্রমণ বাড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে। তবে আশার কথা ময়মনসিংহে সংক্রমণ ১৯০০ ছাড়ালেও এক হাজারের বেশি রোগী সুস্থ হয়ে গেছে। মৃত্যুর হারও খুবই কম।
আইইডিসিআরের তথ্য বলছে, গত ২৭ মে (৮০তম দিন) পর্যন্ত ঢাকা শহরের বাইরের জেলাগুলোর মধ্যে এক হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে ১ হাজার ৯১৭ জন এবং চট্টগ্রামে ১ হাজার ৯৪৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। আর পাঁচ শতাধিক রোগী শনাক্ত হওয়া জেলা ছিল ঢাকা, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লা। ৩৭ দিনের ব্যবধানে ৩ জুলাই ঢাকা শহরের বাইরে আরও ৩৪ জেলায় পাঁচ শতাধিক রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৬ জেলায়। সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় রোগী শনাক্ত হয়েছে। চট্টগ্রামে এখন শনাক্ত রোগী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৫ জনে এবং নারায়ণগঞ্জে শনাক্ত রোগী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৪৮ জনে।
আইইডিসিআরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এক হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হওয়া আরও ১৪ জেলার মধ্যে কুমিল্লায় ৩ হাজার ৬৭০ জন, গাজীপুরে ৩ হাজার ২৭০ জন এবং ঢাকা জেলায় (ঢাকা মহানগর বাদে) ৩ হাজার ১০৬ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। অথচ ২৭ মে পর্যন্ত কুমিল্লায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৮০ জন। অপরদিকে গাজীপুরে ৬১৮ জন এবং ঢাকা জেলায় ৬২৯ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, কক্সবাজার, নোয়াখালী, সিলেট ও বগুড়া জেলায়ও সংক্রমণ দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এই ৬ জেলায় এরই মধ্যে দুই হাজারের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, বরিশাল, ময়মনসিংহ এবং খুলনা জেলায়ও শনাক্ত হয়েছে এক হাজারের বেশি রোগী।
এদিকে ৫ শতাধিক রোগী শনাক্ত হওয়া অন্য জেলাগুলো হলো- মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোনা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর ও কুষ্টিয়া।
Leave a Reply