রাজধানীর চিরসাথী ট্রাফিক জ্যাম নেই। বায়ুদূষণ কমে সবুজ বেড়েছে। তবুও প্রতিদিন বোবা কান্নায় শহর ছাড়ছে মানুষ। অন্তঃহীন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পরও গ্রামে ফিরছে সবাই। শহরের বাড়িগুলোতে টু-লেটের সংখ্যা বাড়ছে। কারো কারো চাকরি চলে গেছে। ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসাও বন্ধ। ঝুঁকির মুখে বেসরকারি খাতের চাকরি আছে তো বেতন নেই। আবার কারো বেতন কমে গেছে। এসএমই সেক্টরে ধস নেমেছে।
এক হিসাবে দেখা যায়, এরই মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি লোক ফিরে গেছে গ্রামে। উঠতি মধ্যবিত্তের একটা অংশ কম ভাড়ার বাসায় চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কম ভাড়ার মেসে উঠেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, গত ২০ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া অনেকগুণ বেড়েছে। এরই মধ্যে খাবার খরচ, শিক্ষা, যাতায়াত, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ বিল, গ্রামে থাকা মা-বাবার দেখভাল আর মোবাইল বিল খরচ করে পকেটে আর কিছুই থাকে না। প্রতি মাসের শেষ কটা দিন ধারদেনা করে চলে, কোনো সঞ্চয় নেই, তাই এই বাড়িভাড়ার চাপেই শহর ছাড়ছে মানুষ। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে নিম্নবিত্তের কাতারে নেমে যাবেন বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিসংখ্যান মতে, দেশে ৯০ লাখ মানুষ আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি করেন। এর মধ্যে ১৫ লাখ সরকারি খাতে। বাকি ৭৫ লাখ মানুষ বেসরকারি খাতে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন ছয় কোটি ৮ লাখ মানুষ।
অপর দিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, করোনায় দেশে নতুন করে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ গরিব হয়েছেন। দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যুক্ত হওয়া নতুন এ সংখ্যার ফলে এখন দেশে গরিব মানুষ পাঁচ কোটির বেশি। বিরাজমান পরিস্থিতিতে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালকের আশঙ্কা, অর্থনীতির যে স্থবির অবস্থা, তা যদি আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে, তাহলে ৩০ শতাংশ মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে।
গবেষণা সংস্থাটি বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তের ওপর মূল চাপ কতটা পড়বে কিংবা তারা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নির্ভর করবে অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়ায় তার ওপর। চলতি জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা বুঝা যাবে। বিআইডিএস গবেষকদের মতে, বাজেটে একটা প্রাক্কলন করা হয়েছে চলতি বছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টার থেকে তৃতীয় কোয়ার্টারের মধ্যে অর্থনীতি ৫০ শতাংশ ঘুরে দাঁড়াবে। যদি তা হয় তাহলে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেয়া যাবে। আর যদি ঘুরে না দাঁড়ায় তাহলে মধ্যবিত্তের জন্য আরো কঠিন পরিস্থিতি আসবে। জুন পর্যন্ত তথ্য তুলে ধরে বিআইডিএসের জরিপে বলা হচ্ছে, বেসরকারি খাতের চাকরির আয় এরই মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। একটি অংশের চাকরি আছে, কিন্তু বেতন নেই। আবার কারো বেতন কমে গেছে। এসএমই সেক্টরে ধস নেমেছে। এসব কারণে অসচ্ছল ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। যার সংখ্যা হবে দেড় কোটি থেকে আড়াই কোটির মতো।
এতে আরো বলা হয়, করোনায় এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। এ অবস্থায় চলতি বছরের তৃতীয় কোয়ার্টারের ওপরই নির্ভর করবে আমাদের অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াবে আর মধ্যবিত্ত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সংস্থাটি বলছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া দেড় থেকে আড়াই কোটির মতো নতুন দরিদ্রের অধিকাংশই অসচ্ছল ঝুঁকিপূর্ণ পরিবার। কারণ এ সময় তাদের মজুরি শ্রমের কোনো সুযোগ ছিল না। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও কোনো ব্যবসা ছিল না। তবে মধ্যবিত্তের হিসাবটা একটু জটিল। তাদের মূল আশ্রয়স্থল হলো তারা মাসিক বেতনের ভিত্তিতে চাকরি করে। ব্যাংকের সাথে মধ্যবিত্তদের একটা লেনদেন আছে। তাদের মোটামুটি একটা সঞ্চয় আছে। কিন্তু অর্থনীতির যে স্থবির অবস্থা, এ রকম যদি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে, তাহলে ৩০ শতাংশ মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা জরিপ অনুযায়ী করোনার আগে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২০.৫ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। আর চরম দরিদ্র ছিল ১০ শতাংশ। অপর দিকে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, এক জনের দৈনিক আয় এক ডলার ৯০ সেন্ট হলে ওই ব্যক্তিকে দরিদ্র ধরা হয় না। এর নিচে হলে দরিদ্র। মধ্যবিত্তের আয় সম্পর্কিত বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি একটু বেশি। তাদের মতে, প্রতিদিন যাদের আয় ১০ থেকে ৫০ ডলার তারা মধ্যবিত্ত।
অন্য দিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, এক ব্যক্তির ক্রয়ক্ষমতা (পিপিপি) যদি প্রতিদিন দুই ডলার থেকে ২০ ডলারের মধ্যে হয় তাহলে তাকে মধ্যবিত্ত বলা যায়। এই হিসাবে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত হলো তিন কোটি ৭ লাখ। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুই থেকে চার ডলার প্রতিদিনের আয় হলেই মধ্যবিত্ত। সেই হিসাবে যার মাসিক আয় ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা সেই মধ্যবিত্ত। এটা দেশের জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ। ১৬ কোটি মানুষের হিসাবে সংখ্যাটি দাঁড়ায় চার কোটি ৮০ লাখ।
ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোরশেদ বলছেন, দিনে ১.৯ ডলারের দ্বিগুণ যাদের আয় তাদের আমরা বলি নিম্ন মধ্যবিত্ত। এরাই এখন সবচেয়ে বেশি সঙ্কটের মুখে আছেন। তারাই হয়তো দরিদ্রের কাতারে নেমে গেছেন। কিন্তু যারা মধ্যবিত্ত, তারা এখনো টিকে আছেন। তাদের সংখ্যা হয়তো ঠিকই থাকবে। হয়তো ব্যক্তির পরিবর্তন হবে। কারণ নতুন পরিস্থিতিতে পেশার পরিবর্তন হবে। নতুন ধরনের ব্যবসা আসবে, কাজ আসবে। কেউ ভালো অবস্থায় যাবেন। আবার কেউ খারাপ অবস্থায় পড়বেন।
কিন্তু বিআইডিএসের জরিপ বলছে, করোনায় ফর্মাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম তাদের ৫৬.৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। ৩২.১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩.২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭.২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯.৪ শতাংশের আয় কমেছে এবং ৬.৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে।
Leave a Reply