টানা দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। দলীয় প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে গুটিকয়েক নেতা আওয়ামী লীগে সুবিধাবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে, এমন দাবি দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের। তাদের মতে, যত দ্রুত সম্ভব এদের চিহ্নিত করে দল থেকে বের না করলে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়বে। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন ও অর্জন এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। কিন্তু গুটিকয়েক সুবিধাভোগীর জন্য আওয়ামী লীগ নানা প্রশ্নের সম্মুখীন।
আবার কিছু নেতাকর্মীর বক্তব্য ভিন্ন। তারা বলছেন, গত নির্বাচনের আগে বিভিন্ন দলের সমর্থকরা আওয়ামী লীগে যোগদান করেছে। আওয়ামী লীগও আগপাছ বিচার না করে তাদের গ্রহণ করেছে। যোগদান করেছে দলের সহযোগী সংগঠনেও। দলে এসেই ওইসব নেতারা সংক্ষেপে গন্তব্যে পৌঁছার ধান্দা শুরু করে। দলের দুর্দিনের ত্যাগী নেতাদের ডিঙ্গিয়ে জায়গা করে নেয় তারা। আর তারই
চালচিত্র দেখা যাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূইঞা, নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া ও সর্বশেষ রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদের ক্ষেত্রে।
ক্যাসিনো কর্মকা-সহ নানা অপরাধে গত বছরের শেষ দিকে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূইঞা। গ্রেপ্তারের পর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জানান, খালেদ অতীতে বিএনপিতে সম্পৃক্ত ছিলেন, সুযোগ পেয়ে কারও হাত ধরে যুবলীগে এসেছেন। খালেদের অপরাধের সূত্র ধরে যুবলীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয় যুবলীগের প্রভাবশালী চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকেও। অবৈধ অস্ত্র, চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে লিপ্ত থাকার কারণে চলতি বছরে গ্রেপ্তার হন নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া। তার গ্রেপ্তারের পর হঠাৎ করে যুব মহিলা লীগের নেত্রী হয়ে বিপুল অর্থের মালিক বনে যাওয়ার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। দুর্নীতি দমন কমিশন ইতোমধ্যে তার ৪ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে। পাপিয়া আইনের আওতাধীন থাকলেও তার প্রশ্রয়দাতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। করোনা ভাইরাস টেস্টের ভুয়া সনদ প্রদান ও চিকিৎসার নামে প্রতারণাসহ ৩২ মামলার আসামি রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ এখন পলাতক। তিনি আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির সদস্য হিসেবে নানা জায়গায় পরিচয় দিয়ে নানা সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একাধিক নেতার সঙ্গে তার ছিল দহরম মহরম সম্পর্ক। সাহেদের হাসপাতালে র্যাবের অভিযান ও হাসপাতাল সিলগালা করার পর আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন সাহেদ উপকমিটির বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এলেও তিনি কখনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনে এখনো অনেক খালেদ মাহমুদ ভূইঞা, পাপিয়া ও সাহেদের মতো অনুপ্রবেশকারী আছে। গত বছর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে এ রকম আড়াই হাজারজনের একটি তালিকা দলীয় সভাপতি দলের নেতাদের হাতে তুলে দিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু কতজন অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে দলকে সুসংগঠিত ও হাইব্রিডমুক্ত করার উদ্যোগ নেন স্বয়ং দলের প্রধান শেখ হাসিনা। এর অংশ হিসেবে তিনি দলের ভেতরে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান শুরু করেন। গণভবনে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ডেকে অনুপ্রবেশকারীদের দলের সব পদ-পদবি থেকে বাদ দিতে বলেন। একই সঙ্গে আগামীতে যেন আর কোনো অনুপ্রবেশ না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক থাকারও নির্দেশ দেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক আওয়ামী লীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতা আমাদের সময়কে বলেন, সারাদেশে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে সুবিধাভোগীই শুধু নয়, দেশদ্রোহী রাজাকারদেরও দলীয় পদে বসানো হয়েছে। অন্যদিকে পদবঞ্চিত করা হয়েছে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাদের। এতে অনেকগুলো ইউনিটে বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। তৃণমূলের পাশাপাশি সুবিধাভোগীরা বাসা বেঁধেছে দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটিতেও। এটি পদ বাগিয়ে নিয়েই সদ্য বিতর্কিত রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদের মতো ব্যক্তিরা জনস্বার্থবিরোধী কর্মকা- শুরু করে। বদনাম হয় মূল দলের।
দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এদের চিহ্নিত করে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। বহিষ্কারের আগে সন্দেহভাজনদের চোখে চোখে রাখা হবে। এমনকি গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের কোন নেতারা লিখছেন, কারা টিভির টকশোতে দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন এ বিষয়টিও মনিটরিং করা হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, অনুপ্রবেশকারী বা হাউব্রিডদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অভিযান অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অনুপ্রবেশকারী, সুবিধাভোগী, প্রতারক, সমাজবিরোধী, বিএনপি, জামাত এদের দল থেকে বাদ দেওয়ার জন্য তালিকা করে আমাদের দিয়েছেন। সেই তালিকা অনুযায়ী আমাদের অভিযান চলছে। এদের দল থেকে দ্রুত বের করার জন্য জোরদার অভিযান চলবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান বলেন, দলের কেউ যদি বিপথগামী হয়ে থাকে বা অন্যায় করে তা হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। দলীয় সাংগঠনিক নিয়মানুযায়ীও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আপনারা দেখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে তার শুরুটা করেছে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনে শুদ্ধি অভিযান চালানোর মধ্য দিয়ে। সুতরাং এটাই প্রমাণ করে আওয়ামী লীগে অন্যায়কারীর কোনো ক্ষমা নেই।
Leave a Reply