মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দেশ সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার ও ইউএই (দুবাই-আবুধাবি) থেকে কমপক্ষে ১৫ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিককে ফেরত পাঠানোর শঙ্কা প্রকাশ করছেন দেশগুলোতে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস, প্রবাসী বাংলাদেশী ও অভিবাসন বিশ্লেষকরা। তবে এখনই তাদের ফেরত পাঠানো হবে এমন কিন্তু নয়। ১ থেকে ৩ বছরের মধ্যে শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বিদেশী অভিবাসী কর্মীর তালিকার মধ্যে ‘ফ্রি ভিসার’ নামে যাওয়া বাংলাদেশী কর্মীর সংখ্যাও কম নয়। অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এবং করোনার কারণে শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিজ নিজ দেশগুলোর সরকার।
গতকাল শনিবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুয়েত সরকার দেশে অভিবাসীদের সংখ্যা কমিয়ে আনতে একটি প্রবাসী কোটা বিল প্রণয়ন করেছে। স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই খসড়া আইনে বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য মাত্র ৩ ভাগ কোটা প্রস্তাব করা হয়েছে। এই আইন পাস হলে দেশটিতে অবস্থানরত আড়াই লাখের বেশি অভিবাসীকে দেশে ফেরত আসতে হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
কুয়েতের জনসংখ্যা ৪৩ লাখ, এর মধ্যে ৩০ লাখ অভিবাসী। শতাংশের হিসাবে যা প্রায় ৭০ ভাগ। কুয়েতের জনসংখ্যার ৭০ ভাগ অভিবাসী হওয়ায় দেশটির সরকার সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছে অভিবাসীর সংখ্যা পর্যায়ক্রমে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে যাতে জনতাত্ত্বিক ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। এ লক্ষ্যে কুয়েত পার্লামেন্টের একটি কমিটি সম্প্রতি এ সংক্রান্ত খসড়া কোটা বিল অনুমোদন করে। প্রস্তাবিত বিল আইনে পরিণত হলে আড়াই লাখেরও বেশি বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠানো হবে। সেখানে বিভিন্ন দেশের অভিবাসীকে কোটায় ভাগ করে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
গতকাল কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিবাসী শ্রমিকদের ফেরত পাঠাতে কুয়েত সরকারের পক্ষ থেকে একটি টেকনিক্যাল কমিটি করা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে কতসংখ্যক বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা তারা করছে সেটি আমরা আগেভাগে কিভাবে বলব? কুয়েত সরকার এখনো তো আমাদের অফিসিয়ালি এ বিষয়ে কিছুই জানায়নি, যা বলা হচ্ছে তা পত্রিকার খবর। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পত্রিকার প্রতিবেদনে কুয়েত থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীসহ বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ফেরত যাবে বলা হয়েছে। তবে আমার মনে হচ্ছে বিদেশী শ্রমিকের ওপর কুয়েত অনেকটাই নির্ভরশীল। বর্তমানে কুয়েতে ক্লিনিং ও ড্রাইভার পদে যেসব বিদেশী কাজ করছে সেসব পদে কি কুয়েতিরা চাকরি করবে?
আমার মনে হয় করবে না। তবে বিদেশী শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর সংবাদ পত্রিকায় আসার পর অনেক বাংলাদেশী আতঙ্কে আছেন বলে জানান তিনি। যারা ছুটিতে যেত তারাও আর এখন যেতে চাচ্ছে না। রাষ্ট্রদূত বলেন, এ পর্যন্ত অবৈধ শ্রমিক মিলিয়ে ৫ হাজারের মতো কর্মী কুয়েত থেকে বাংলাদেশে চলে গেছে। এর মধ্যে কারাবন্দী বাংলাদেশীও রয়েছে।
এর আগে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ নয়া দিগন্তকে বলেছিলেন, করোনা মহামারীতে অর্থনৈতিক মন্দা ও দিন দিন তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণে আগামী ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে সৌদি আরব থেকে ১০ লাখের মতো বাংলাদেশী শ্রমিককে ফেরত যেতে হতে পারে। ফেরত পাঠানোর আরো একটি কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, সৌদি সরকার ৭০ ভাগ বিদেশী অভিবাসীকে ফেরত পাঠিয়ে সেখানে দেশের নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির নীতি গ্রহণ করেছে। দেশটিতে বর্তমানে ২২ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালে প্রণীত সৌদিকরণ নীতি বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ বিদেশী কর্মীদের সাথে থাকা পরিবারের সদস্যদের জন্য মাসিক ফি ধার্য করেছে এবং ইকামা বা দেশটিতে থাকার অনুমতির জন্য ফি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমে যাওয়ায় সৌদি আরবের উন্নয়ন কাজের গতি কমে যাবে। অনেক প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হবে বা স্থগিত হতে পারে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ফেরত আসার কারণ হিসেবে দেশটিতে যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি এবং দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস। দেশটির পরিচ্ছন্নতা কাজে নিয়োজিত ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কর্মী বাংলাদেশী এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তাদের বেশির ভাগকেই আর প্রয়োজন হবে না সৌদি আরবের।
শুধু সৌদি আরব বা কুয়েত নয় একইভাবে কাতার সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও লক্ষাধিক শ্রমিককে দেশে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে দেশগুলোর সরকার।
গতকাল অভিবাসন বিশেষজ্ঞ জয়নাল আবেদিন জাফরের কাছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার জানা মতে সৌদি আরব, কুয়েত কাতার ও দুবাই থেকে দেড় মিলিয়ন (১৫ লাখ) বাংলাদেশীকে ফেরত আসতে হতে পারে। এর মধ্যে ২-৩ লাখ ফ্রি ভিসার নামে যাওয়া শ্রমিক রয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সৌদি আরবে যেসব প্রজেক্টের মেয়াদ ৩ বছর আগে শেষ হয়েছে সেই প্রজেক্টগুলোকে সরকার আর প্রায়োরিটি দেবে না। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, একটি এগ্রিকালচারাল প্রজেক্ট তিন বছর ধরে চলছে। তারা চিন্তা করছে এভাবে আর এই প্রজেক্ট রাখা ঠিক হবে না। মেইনটেন্যান্সের জন্য তারা ১০ ভাগ লোক রাখবে। আর ৯০ ভাগ বিদায় করে দেবে।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ২ বছর পর পর প্রত্যেক শ্রমিকের রেসিডেন্স স্ট্যাম্প করা হয়। রিনিউ করার সময় পারসেন্টেজ কমিয়ে দেবে। তখন ১০০ জনের পরিবর্তে তারা বলবে ২০ জন লোক রাখো। তখনই সংশ্লিষ্টরা ওদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হবে। এটি অলরেডি শুরু হয়েছে। আমার জানা মতে, তাদেরকে এখন অর্ধেক বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে। আলটিমেটলি ফ্লাইট শুরু হলে তাদের পাঠিয়ে দেবে। তার মতে, বাংলাদেশ থেকে রেগুলার লোক যাবে (প্রায়োরিটি প্রজেক্ট) কিন্তু যা যাবে তার ৫-৭ গুণ বেশি লোক ফেরত আসবে।
জয়নাল আবেদিন আরো বলেন, প্রত্যেকটা মিডলইস্ট সরকার তাদের বাজেট পুনর্নির্ধারণ করে প্রায়োরিটি প্রজেক্ট (সার্ভিস ওরিয়েন্টেড) রেখে লেস প্রজেক্টগুলোকে ক্লোজ করে দেবে। এতে করে অনেক লোক চাকরি (জব) হারাবে। তাদের একটা বিরাট অংশ দেশে ফিরে আসবে। আমার ধারণা সৌদি আরব থেকে এ বছর ২-৩ লাখ শ্রমিক ফেরত আসবে। একইভাবে কাতার থেকে ২৫-৩০ হাজার ফিরে আসবে মিনিমাম। ইউএই থেকে ফেরত আসবে এক থেকে দেড় লাখ শ্রমিক। কারণ ইউএইতে অনেক অবৈধ শ্রমিক রয়েছে। তারা ভিজিট ভিসায় গিয়ে কাজ করছে। তাই অবৈধরা থাকতে পারবে না। কুয়েত থেকেও ফ্রি ভিসাসহ অন্যান্য বাংলাদেশী ফিরে আসবে। সবমিলিয়ে এক থেকে দেড় মিলিয়ন লোক ফেরত আসবে।
সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরলেন ৪১২ শ্রমিক : সৌদি আরবের দাম্মামে আটকে পড়া ৪১২ জন প্রবাসী বাংলাদেশী দেশে ফিরেছেন। গতকাল শনিবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইটে তারা ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।
বিমানের জনসংযোগ বিভাগের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
উল্লেখ্য, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১৭টি আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে শুধু লন্ডন আর চীনে ফ্লাইট চলাচল করছে। আর ঢাকা থেকে কাতারে ট্রানজিট যাত্রীরা চলাচল করতে পারছেন। এরমধ্যে বিভিন্ন দেশে আটকে পড়া বাংলাদেশীদের দেশে ফেরাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিশেষ ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে।
Leave a Reply