চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা একসময় সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে জিম্মি ছিল এখানকার মানুষ। সন্ত্রাসী কর্মকা-ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল হাজার হাজার বাসিন্দা। বর্তমানে সেই পরিস্থিতি নেই। কিন্তু এলাকার মানুষের মনে সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি মনে করে দিয়েছে দুবাইতে নারী পাচারের মূল হোতা ঢাকায় গ্রেপ্তার আজম খান।
কোরবানির পশুর চামড়া, কবরস্থানের গাছ লুট, অপহরণ, নির্যাতন থেকে ছিঁচকে চুরি কিছুই বাদ যায়নি। ২০০০ সালে ওসমান বাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে অপরাধের রাজত্ব কায়েম করেছিল আজম খান। ২০০২ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ফটিকছড়ি থানায় হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতিসহ পাঁচটির অধিক মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালের শেষ দিকে বিদেশ পাড়ি দেওয়া আজম অল্পদিনে চমকে দেয় পুরো এলাকাবাসীকে। যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়েছে। অট্টালিকা, দামি গাড়ি, শানশওকত। হঠাৎ আমূল বদলে যাওয়া আজমের উত্থানে এলাকার মানুষ বিস্মিত। কারণ খুঁজে পায় না তারা। কীভাবে হঠাৎ করে টাকার কুমির বনে গেলেন। সেই উত্তর মিলেছে প্রায় ১৩ বছর পর। দুবাই ও ওমানের হোটেলে ড্যান্সবার হোটেল ব্যবসার আড়ালে নারী পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর।
ফটিকছড়ি থানার ওসি মো. বাবুল আকতার বলেন, আজম খানের সব তথ্য ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। তার সহযোগীদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। এদিকে আজম খান তিনটি পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন। একেক দেশে একেকটি ব্যবহার করতেন।
সিঙ্গাপুর বা ওমান যাওয়ার সময় দুবাই যাওয়ার পাসপোর্ট ব্যবহার করত না। ওমান যেতে ব্যবহার করতেন ভিন্ন পাসপোর্ট। ওমানের দুটি হোটেলে তার শেয়ার রয়েছে। আছে ফলের ব্যবসাও।
জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আজম খানের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুবাই ও ওমানে নারী পাচার করতেন। দুবাই থেকে স্বর্ণপাচারের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কও আছে। আজম খানের এইচ-০১৬৫১২৮ ও আর-০৫৭৯৪৬৯ নম্বরে দুটি পাসপোর্ট। আজম খান দুবাইতে আসা-যাওয়া করতেন এ দুটি পাসপোর্ট ব্যবহার করে। বাংলাদেশ থেকে নারী পাচার করে তাদের যৌনকর্মে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুবাইতে পাসপোর্ট দুটির বিপরীতে মামলা হয়। ফলে ওই দুটি পাসপোর্ট ব্যবহারকারী ব্যক্তি আজম খানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুবাই সরকার। কিন্তু আজম খান কিউ-০৩৩৭৯৯২ তৃতীয় পাসপোর্স নেন। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত এটি ব্যবহার করেই দুবাইতে যাওয়া-আসা করেছেন।
তিন পাসপোর্টের বিষয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আবু সাঈদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘তার তিনটি পাসপোর্টই পুরনো (হাতে লেখা)। ২০১৫ সাল থেকে এসব পাসপোর্ট দিয়ে ভ্রমণ করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে ই-পাসপোর্ট নিয়েছে কিনা সেটি জানা যায়নি। তার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
মা জানেন ফল ব্যবসায়ী : ফটিকছড়িতে আজম খানের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে তিনতলাবিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি। নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। স্থানীয়রা জানান, ছয় মাস আগে আজম খান ফটিকছড়ির বাড়িতে আসেন। এ সময় এলাকায় তিনি বেশ কিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছেন।
ফটিকছড়ি পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মাহালিয়া টিলা এলাকার খেরু মুহুরীবাড়ির মৃত মাহাবুবুল আলমের তিন ছেলের মধ্যে সবার বড় আজম খান ওরফে মোজাহার ওরফে আজিম উদ্দিন। লেখা পড়ায় প্রাথমিকের গ-ি পার হতে না পারা আজমের মা ছবিলা খাতুনের দাবি, তার ছেলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কারণ তার ছেলে দুবাইতে ফলের ব্যবসা করে। আজমের স্ত্রী সেলিনা আক্তার জানান, স্বামীর বিরুদ্ধে নারী পাচারের যে অভিযোগ সে বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি। এমনকি সন্দেহ করার মতো কোনো বিষয় তার চোখে পড়েনি।
জিয়া আদর্শ একাডেমির কেন্দ্রীয় সভাপতি : জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সক্রিয় থাকা ও পরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন আজম খান। জামায়াত-বিএনপি ঘরানার প্রায় সব রাজনৈতিক নেতার সঙ্গেই তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি দলীয় শীর্ষ নেতারা দুবাই গেলে আজম খানের হোটেলে উঠেছেন। জিয়া আদর্শ একাডেমি নামের একটি সংগঠন তৈরি করে সেটির কেন্দ্রীয় সভাপতি হন তিনি। দুবাই থেকে দেশে এলে ওই সংগঠনের ব্যানারে সভা-সমাবেশ করতেন। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এসব সভা-সমাবেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
২০১৮ সালের ১৪ জুলাই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সভায় মঞ্চে আজম খানের একপাশে সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এবং অন্য পাশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানকে দেখা গেছে। একই দাবিতে গত বছরের ৪ মে এক প্রতিবাদসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমদ।
Leave a Reply