প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সংকটে পড়েছে বিশ্বের অর্থনীতি।
সাধারণ মানুষের মতো বিশ্বের ধনকুবেরদের আর্থিক অবস্থারও পরিবর্তন এসেছে। কারও সম্পদ বেড়েছে, কেউ বা হারিয়েছেন। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেস্ক অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের
অবস্থারও পরিবর্তন এসেছে। সেলফ মেইড বিলিয়নিয়ার ও প্রযুক্তি খাতের মার্কিন উদ্যোক্তারা
প্রায় দখল করে রেখেছেন শীর্ষস্থান। বিস্তারিত জানাচ্ছেনÑ শামস্ বিশ্বাস
সের্গেই ব্রিন (ঝবৎমবু ইৎরহ)
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে শীর্ষ নয়ে রয়েছেন সার্চ ইঞ্জিন গুগলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন। করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে গুগলের আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজের সম্পদ কমলেও সের্গেই ব্রিনের সম্পদ বেড়েছে ১৪.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে ৪৬ বছর বয়স্ক সেলফ মেইড মার্কিন বিলিয়নিয়ার সের্গেই ব্রিনের নিট সম্পদের পরিমাণ ৬৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জেফ বেজোস
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেফ বেজোসই এখন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। টানা তৃতীয়বারের মতো তিনি শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছেন। ইন্টারনেটে পুরনো বই বিক্রি থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রথম ‘ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানি’ হয়েছে তার অ্যামাজন। করোনা আঘাত থেকে তিনিও মুক্ত পাননি। সারাবিশ্বেই কেনাকাটা কমে গেছে। বাদ যায়নি অনলাইনে কেনাকাটাও। এর প্রভাব পড়েছে ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজনের ওপরও। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এই সময়ে ২.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিট সম্পদ হারিয়েছেন প্রযুক্তি খাতের এই মার্কিন উদ্যোক্তা। বর্তমানে ৬৫ বছর বয়স্ক সেলফ মেইড বিলিয়নার জেফ বেজোসের নিট সম্পদের পরিমাণ ১৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিল গেটস
০২. ১৩ বছর ধরে বিশ্বর শীর্ষ ধনীর স্থানটা নিজের করে রেখেছিলেন সফটওয়্যার জায়ান্ট মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী বর্তমানে তার অবস্থান শীর্ষ দুইয়ে। ১৯৭৫ সালে বিল গেটস ও পল এলেন এক সঙ্গে ‘মাইক্রোসফট’ প্রতিষ্ঠা করেন। করোনা প্রাদুর্ভাবের ভেতরেও প্রযুক্তি খাতের এই মার্কিন উদ্যোক্তার নিট সম্পদ বেড়েছে ৫৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সমাজসেবাই বর্তমানে ব্রত করে নেওয়া ৬৪ বছর বয়স্ক সেলফ মেইড বিলিয়নিয়ার বিল গেটসের নিট সম্পদের পরিমাণ ১৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
মার্ক জাকারবার্গ
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে শীর্ষ চারে রয়েছেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রেসিডেন্ট মার্ক জাকারবার্গ। সবচেয়ে কম বয়সে বিলিয়নিয়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। কয়েক সহপাঠী মিলে ২০০৪ সালে ফেসবুককে একটি ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন যখন তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাইনে থাকা মানুষের উপচেপড়া ভিড় ফেসবুকে থাকায় প্রযুক্তি খাতের এই মার্কিন উদ্যোক্তার সম্পদ বেড়েছে ৪০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে ৩৬ বছর বয়স্ক সেলফ মেইড বিলিয়নার মার্ক জাকারবার্গের নিট সম্পদের পরিমাণ ৯১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ল্যারি পেজ
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে
শীর্ষ সাতে রয়েছেন গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান আলফাবেট ইনকরপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ল্যারি পেজ। ১৯৯৮ সালে তিনি ও সের্গেই ব্রিন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন সার্চ ইঞ্জিন গুগল। ল্যারি পেজ হলেন পেজ র্যাংকের উদ্ভাবক। তা গুগলের সার্চ র্যাংকিং এলগরিদম হিসেবে বেশি পরিচিত। করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাইনে থাকা মানুষের উপচেপড়া ভিড় গুগল-ইউটিউব থাকলেও প্রযুক্তি খাতের এই মার্কিন উদ্যোক্তার সম্পদ কমেছে ১০.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে ৪৭ বছর বয়স্ক সেলফ মেইড বিলিয়নিয়ার ল্যারি পেজের নিট সম্পদের পরিমাণ ৭১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
মুকেশ আম্বানি
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে শীর্ষ আটে রয়েছেন ভারতের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ৬৩ বছর বয়সী মুকেশ আম্বানি। একমাত্র এশীয় হিসেবে তিনি ঢুকে পড়েছেন বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনীর তালিকায়। আশির দশকের শুরুর দিকে পারিবারিক ব্যবসায় হাতেখড়ি হয় মুকেশ আম্বানির। স্ট্যানফোর্ড বিজনেস স্কুলে এক বছর পড়ার পর একটি পলিয়েস্টার কারখানার নির্মাণকাজ তদারকির জন্য তার বাবা ধিরুভাই আম্বানি তাকে ভারতে ডেকে পাঠান। ফ্যাব্রিকস, টেক্সটাইলস ও জ্বালানি খাতে বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্যের বাটোয়ারা না করেই ২০০২ সালে মারা যান ধিরুভাই। ফলে দুই ভাই মুকেশ ও অনিল আম্বানির মধ্যে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব। পরে মা কোকিলাবেন আম্বানির মধ্যস্থতায় দুই ভাইয়ের মধ্যে ব্যবসা বাটোয়ারা হয়। মুকেশ ব্যবসা-বাণিজ্য দিন দিন ভালো করলেও ছোট ভাই অনিল আম্বানি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। মুকেশ আম্বানি এখন বাস করেন বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামি বাড়িতে। এটির নাম অ্যান্টিলিয়া। ভারতের মুম্বাই শহরের আলটামাউন্ট রোডে অবস্থিত এই বাড়ির দাম ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। তা ভারতের ১৪ হাজার কোটি রুপির সমান। এই বাড়ির চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল আর একটি বাড়িই আছে বিশ্বে। সেটি হলো ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রধান প্রশাসনিক দপ্তর বাকিংহাম প্যালেস। করোনা প্রাদুর্ভাবের ভেতরেও মুকেশ আম্বানির নিট সম্পদ বেড়েছে ২.৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে তার নিট সম্পদের পরিমাণ ৭১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বার্নার্ড আরনল্ট
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে শীর্ষ দশে থাকা একমাত্র ইউরোপীয় হলেন ফ্রান্সের বার্নার্ড আরনল্ট। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিলাসবহুল পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এলভিএমএইচের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও চেয়ারম্যান। এই সময়ের ফ্রান্স এর সবচেয়ে ধনশালী ব্যক্তি তিনি। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে তিনি রয়েছেন শীর্ষ তিনে। বিশ্ব জয়ের উচ্চাকাক্সক্ষা থেকেই ১৯৮৭ সালে তিনি এলভিএমএইচ গড়ে বিলাস পণ্যের বাজারে প্রবেশ করেন। এ কোম্পানিটিকে গড়ে তোলার পাশাপাশি তিনি অনেক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। করোনা প্রাদুর্ভাবের ভেতরেও তার সম্পদ বেড়েছে ৫৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে ৭১ বছর বয়স্ক সেলফ মেইড বিলিয়নার বার্নার্ড আরনল্টের নিট সম্পদের পরিমাণ ৯৪.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
স্টিভ বলমার
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে শীর্ষ পাঁচে রয়েছেন মাইক্রোসফটের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) স্টিভ বলমার। তিনি ১৯৮০ সালে মাইক্রোসফটের ব্যবসা ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন মাইক্রোসফটে বিল গেটসের নিয়োগকৃত ৩০তম কর্মী। তাকে প্রথমে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার বেতনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। একই সঙ্গে কোম্পানিতে মালিকানার কিছু অংশও দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে যখন মাইক্রোসফট ইনকরপোরেটেড হয়, তখন তার শেয়ারের পরিমাণ ছিল ৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে তিনি মাইক্রোসফটের সিইও পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। করোনা প্রাদুর্ভাবে তার সম্পদ কমেছে ৩৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে ৬৪ বছর বয়স্ক সেলফ মেইড মার্কিন বিলিয়নিয়ার স্টিভ বলমারের নিট সম্পদের পরিমাণ ৭৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ওয়ারেন বাফেট
বিংশ শতকের সবচেয়ে সফল বিনিয়োগকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয় ওয়ারেন বাফেটকে। তিনি প্রখ্যাত জনহিতৈষী ব্যক্তি। তার সম্পদের ৯৯ শতাংশ জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য দান করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ওয়ারেন বাফেট। তিনি ধারাবাহিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে শীর্ষ ছয়ে রয়েছেন তিনি। তার প্রথম শেয়ারটি কেনেন ১১ বছর বয়সে। এখন মনে করেন, তিনি খুব দেরিতে শুরু করেছেন। বিপুল ধনসম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত মিতব্যয়ী। ১৯৫৮ সালে যে বাড়িটি কিনেছিলেন, এখনো ওই বাড়িতেই বাস করেন। তার মোট ২০টি স্যুট আছে। এগুলোর একটিও নিজের টাকায় কেনেননি! ডিজাইনার ম্যাডাম লি তাকে স্যুটগুলো উপহার দেন। করোনা প্রাদুর্ভাবে তার সম্পদ কমেছে ৬৯.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে ৮৯ বছর বয়স্ক সেলফ মেইড মার্কিন বিলিয়নিয়ার ওয়ারেন বাফেটের নিট সম্পদের পরিমাণ ৭২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ইলন মাস্ক
মহামারী করোনা ভাইরাসের মধ্যেও পুঁজিবাজারে কোম্পানির শেয়ারের মূল্য ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে নিজের সম্পদমূল্য বেড়েছে রকেট নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ও মার্কিন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলারপ্রধান নির্বাহী ইলন মাস্কের। করোনা প্রাদুর্ভাবের ভেতরেও তার নিট সম্পদ বেড়েছে ৮.০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ উত্থান অব্যাহত থাকলে অ্যামাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোসকে পেছনে ফেলে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর স্থান দখল করে নিতে পারেন ৪৯ বছরের ইলন মাস্ক। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে অনুযায়ী তিনি বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনীর তালিকায় দশম স্থানে রয়েছেন। অর্থ আদান-প্রদানের জনপ্রিয় মাধ্যম পেপ্যালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক হাইপারলুপ নামক কল্পিত উচ্চগতিসম্পন্ন পরিবহন ব্যবস্থার উদ্ভাবক। বর্তমানে সেলফ মেইড বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্কের নিট সম্পদের পরিমাণ ৬৮.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
Leave a Reply