মোমিন মেহেদী
আজ যখন নতুন প্রজন্ম ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের রাজনৈতিক-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থান নির্মাণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে; তখন বাংলা ভাষাকে-স্বাধীনতাকে বিকৃত করার চেষ্টা করছে ছাত্রশিবির-জামায়াত-জঙ্গী ও দেশবিরোধীচক্র। প্রয়োজনে খোলশ পাল্টে ফেলছে, প্রয়োজনে মুখোশ পড়ে নিচ্ছে; তবু বাংলা ভাষা ও স্বাধীনতাকে কলুষিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এদেরকে পৃষ্টপোষকতা দিচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে ঘাপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা। যারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের নেপথ্য নায়ক ছিলো। এদের পৃষ্টপোষকতায় পরিচালিত অথবা অর্থায়িত বেশ কিঠু এফএম রেডিও, স্যাটেলাইট চ্যানেল ও দৈনিক পত্রিকার পাশাপাশি সাপ্তাহিক, মাসিক ম্যাগাজিনগুলোও শুরু করেছে বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে উপস্থাপন পরিবেশন ও প্রচারে মাঠে নেমেছে। বৃহ্নলা ভাষার জন্ম দিয়ে এরা এগিয়ে যাচ্ছে ছাত্র ও যুব সমাজকে দ্বিধাগ্রস্থ করার লক্ষ্যে। এমন পরিস্থিতিতে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন নতুন প্রজন্মের পাশাপাশি প্রতিটি প্রতিনিধিকে যে- পূর্ববাংলার বাঙালি-অবাঙালি অভিজাত নেতাদের প্রায় সবাই ছিলেন উর্দুর সপক্ষে। শিক্ষিত ও ছাত্র সমাজের একটি বড় অংশও সে ভাবধারাকে সমর্থন করত। তাই ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই সমাজের এই মনোভাবের পরিবর্তন করা জরুরি হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে বুকভরা সাহস আর উদ্যম নিয়ে এগিয়ে আসেন লেখকরা। আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলেছিলেন, ‘হুসেন শাহ, পরাগল খাঁ, ছুটি খা ও অন্যান্য বহু খান পাঠান নৃপতিগণ ইহা হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন যে রাজত্ব স্থায়ী করিতে হইলে দেশের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত। ইহা তাহারা উপলব্ধি করিয়াছিলেন বলিয়াই নিজেদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্য রচনায় উৎসাহ দিয়াছিলেন। ভাষার নিপীড়ন চালাইলে পাঠান মোগল শাসন অনেক আগেই ধ্বংস হইয়া যাইত- কয়েক শতাব্দী তার অস্তিত্ব থাকিত না। এভাবে লেখক-সাহিত্যিকদের দৃঢ়তাপূর্ণ ভূমিকা বাঙালি মানসকে তৈরি করছিল, যার কারণেই ২১ ফেব্রুয়ারি একটি অসাধারণ ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল তারা। আর সব শ্রেণীর সমর্থনে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো পূর্ববাংলায়।
কাজী মোতাহার হোসেন বলেছিলেন, বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের উপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধুমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।
আবুল মনসুর আহমদ কিভাবে দেখেছেন ভাষা প্রসঙ্গ? ‘বাংলা ভাষাই হইবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারি চাকরির অযোগ্য বনিয়া যাইবেন। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফারসির জায়গায় ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া বৃটিশ সামাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারি কাজের ‘অযোগ্য’ করিয়াছিল।
শুধু এখানেই শেষ নয়; আমাদের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে লেখকরা যখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও গবেষণা শুরু করলেন; ঠিক তখনই অর্থাৎ ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন হয়। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন কবি সুফিয়া কামাল। তিনি তার ভাষণে বলেছিলেন, ভালোবাসুন, দেশকে ভালোবাসুন, দেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসুন, আজকের দিনে আমার মতে সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক এক কথায় বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিবানদের সামনে এই ভালোবাসার মন্ত্র ছাড়া আর কোনো মন্ত্র নেই, এই ভালোবাসার শপথ ছাড়া কোনো শপথ নেই।’ পূর্ববাংলাব্যাপী যে নতুন সাংস্কৃতিক প্রেরণার উন্মেষ ঘটছিল, সুফিয়া কামালের ভাষণে তার ইঙ্গিত ছিল। আর তারই সূত্রতায় একুশে আমাদের জীবনে অনির্বাণ একটি প্রেরণা। এই প্রেরণায় ১৯৫২ থেকে আমাদের সংগ্রামী পথচলা। একুশ বাঙালির জাতিসত্তার জাগরণের প্রথম প্রণোদনা। একুশের প্রেরণা ১৯৭১-এ পরিণত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায়। তারই অসামান্য ফসল আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা। এ আমাদের ঐতিহাসিক অর্জন।একুশ কেবল আমাদের মুখের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেনি, দিয়েছে দেশপ্রেমের মহান আবেগ, দিয়েছে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী জীবনবোধ, দিয়েছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে চলার প্রাণশক্তি।আমাদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রেরণার বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারি যেন হাজার তারের এক বীণা। তাতে সৃষ্টি হয়েছে অনেক সুর, অনেক ঝংকার! একুশের বীণায় ঝংকৃত হয়েছে আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিচিত্র সুর।একুশের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে একুশের সংকলনগুলির রয়েছে অনন্য ভূমিকা। এরই প্রথম মাইলফলক হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারী। এটি প্রকাশিত হয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরের বছর – ১৯৫৩ সালে। সংকলনটিতে প্রকাশিত হয় একুশের কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, গান ইত্যাদি। একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনের সূচিপত্র দেখলে এতে সংকলিত সাহিত্যের বৈচিত্রময় প্রকৃতি ও প্রতিবাদী বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়।এই ঐতিহাসিক ও চিরভাস্বর সংকলনটি আমাদের জাতীয় সচেতনতার উদ্বোধনের প্রথম সাহিত্যিক দলিল। এর মাধ্যমে একুশের সংকলন প্রকাশের গৌরবময় ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছিল। সংকলনটি প্রকাশের পর থেকে প্রতি বছর একুশে উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে কত না সংকলন, কত না সাময়িকী। একুশে উপলক্ষে প্রতি বছর প্রকাশিত হয়েছে পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যা। আমাদের সাহিত্য-সৃষ্টির ইতিহাসে এসব সংকলন ও বিশেষ সংখ্যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও ভূমিকা রয়েছে। শোক ও বেদনার একুশ যে জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে, সৃজনের প্রেরণা হয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে এসব সংকলন ও একুশের সংখ্যার অসামান্য অবদান।একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। বর্তমান প্রবন্ধে তারই সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সাহিত্যের উৎকর্ষ বিচার এ-প্রবন্ধের লক্ষ্য নয়। দুইএকুশের প্রেরণার প্রথম সাহিত্যপ্রসূন একটি কবিতা। তা লেখা হয়েছিল চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক এবং সীমান্ত পত্রিকার সম্পাদক মাহবুল উল আলম চৌধুরী। একুশের ঘটনার কথা শুনে সেদিনই লিখেছিলেন সেই কবিতাটি : ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি’। কবিতাটি সে-রাতেই চট্টগ্রামের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে গোপনে ছাপানো হয় এবং পরদিন লালদিঘি মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় পঠিত ও বিলি হয়। প্রকাশের পরপরই মুসলিম লীগ সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।একুশের ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া যে কতটা বেদনার, কতটা যন্ত্রণার, কতটা ক্ষোভের, কতটা নিন্দার তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এই প্রতিবাদী কবিতাটিতে। এ-কবিতায় প্রতিশোধের আগুনের উত্তাপ নিয়ে উচ্চারিত হয়েছিল সর্বস্তরের বাঙালির দাবি :জালিমের গুলিতে যারা প্রাণ দিল সেই সব মৃতদের নামে আমি ফাঁসী দাবী করছি।যারা আমার মাতৃভাষাকে নিবর্বাসন দিতে চেয়েছে তাদের জন্যেআমি ফাঁসী দাবী করছিযাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্যেফাঁসী দাবী করছি যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়েক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছেসেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে।আমি তাদের বিচার দেখতে চাই।এরপর বিগত ছয়টি দশক ধরে অসংখ্য সৃষ্টিতে ভরে গেছে একুশের সাহিত্যের ডালি।একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখা প্রথম একটি গানটি হচ্ছে : ‘ভুলব না ভুলব না এই একুশে ফেব্রুয়ারি।’ রচনা করেছিলেন ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক। একুশের অন্যতম ফসল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা অসাধারণ গান : ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?’ এ-গান আমাদের সাংস্কৃতিক প্রেরণার বিকাশে উজ্জীবনীমন্ত্রের মতো প্রেরণাময়। এ-গান আজ আমাদের কাছে এক প্রতীকী তাৎপর্যে উজ্জ্বল। একুশ পালন, শহিদ স্মরণে, প্রভাতফেরিতে, শহিদ মিনারে এ-গান আমাদের প্রেরণার এক দীপ্র মশাল। এই মশালের আলোতেই পরবর্তীকালে আমরা পেয়েছি আরো অনেক দেশাত্মবোধক গান, অসংখ্য গণসংগীত। একুশের ঘটনা বাংলা কবিতায় কী ধরনের পরিবর্তন এনেছিল তা বোঝা যাবে একুশের আগে ও পরে প্রকাশিত দুটি সংকলনের কবিতা তুলনা করলে। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত নতুন কবিতা সংকলনের কবিতাগুলি ছিল স্বপ্নিল মাধুর্য ও স্নিগ্ধ প্রশান্তিতে ভরা। আর ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনের কবিতা হয়ে উঠেছিল শোকাবহ বেদনা ও ক্ষুব্ধ অঙ্গীকারে উচ্চকিত ও দৃপ্ত। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে তিনি লেখেন :আর যেন না দেখি কার্তিকের চাঁদকিংবা পৃথিবীর কোনো হীরার সকালকোনোদিন আর যেন আমার চোখের কিনারেআকাশের প্রতিভা সন্ধ্যানদীর অভিজ্ঞানআর রাত্রির রহস্যের গাঢ় ভাষা কেঁপে না ওঠে।সৌন্দর্য-সমর্পিত কবিকণ্ঠে এভাবে প্রভাব পড়েছিল বেদনা, ক্ষোভ ও যন্ত্রণার। এভাবেই একুশের প্রেরণা বাংলা কবিতার অঙ্গনে জন্ম দিয়েছিল সমাজ-সচেতন, দায়বদ্ধ অনেক নতুন কবির, যাঁরা নারী ও নিসর্গকে নিয়ে রোমান্টিক ভাবালুতায় নিমগ্ন হওয়ার পথ থেকে সরে এলেন। তাঁরা তাঁদের কবিতায় লিখলেন রক্ত আর অশ্রম্নর কথা, শোষণ ও বঞ্চনার কথা। ভাবিত হলেন সমাজ ও মানুষ, স্বদেশ ও বিশ্বকে নিয়ে, স্বপ্ন দেখলেন মানব-মুক্তির। তাঁদের কবিতায় ফুটে উঠল স্বদেশের রক্তাক্ত ছবি। কবিতা তাঁদের হাতে হয়ে উঠল সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার।হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে একুশের কবিতা শিরোনামে সংকলিত হয়েছিল একগুচ্ছ কবিতা। তাতে শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা সংকলিত হয়। সেসব কবিতায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল মাতৃভাষার জন্যে আবেগময় আকুলতা, শহিদদের জন্যে গভীর বেদনা, হিংস্র শাসকদের বিরুদ্ধে ক্রোধের আগুন। একুশের শোকাবহ ঘটনা কীভাবে দেশের সাধারণ মানুষকে বেদনা-বিহবল করেছিল তার আভাস পাওয়া যায় ফজলে লোহানীর কবিতায় :মৃত্যুকে যারা ভয় করেনি,মৃত্যু তাদের বরণ করেছে,এ খবর গিয়ে গাঁয়ে পৌঁছেছে সবার মুখেই বজ্রশপথ :হাতুড়ি আমরা নামিয়ে নিলামকাসেত্ম-কোদাল থামিয়ে দিলামকাঁচা শহীদের স্মৃতির ভারে।একুশের মহান শহিদদের স্মৃতিতে ছাত্রজনতা বায়ান্নর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে তাৎক্ষণিকভাবে যে শহিদ মিনার গড়ে তুলেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল রাতের আঁধারে। কিন্তু ইটের মিনার ভাঙতে পারলেও বাঙালির হৃদয় জুড়ে গড়ে-ওঠা মিনার যেভাঙা যাবে না, সে-কথাই দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে আলাউদ্দিন আল আজাদের কবিতায়। বাঙালির রক্ত ও অশ্রম্নমথিত আত্মদানের প্রতীক শহিদ মিনারকে তিনি অভিষিক্ত করেছেন হৃদয়-মহিমায় :স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ভয় কি বন্ধু আমরা এখনোচার কোটি পরিবারখাড়া রয়েছি তো।ৃইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরীচার কোটি পরিবার।হাসান হাফিজুর রহমান অনুভব করেছেন, ভাষার জন্যে আত্মদানের ভেতর দিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, জববার দেশের মানুষের ভেতরে সজীব হয়ে উঠছে নতুন প্রাণের দীপ্তি নিয়ে :কি আশ্চর্য প্রাণ ছড়িয়েছে – একটি দিন আগেও বুঝতে পারি নি,কি আশ্চর্য দীপ্তিতে তোমার কোটি সন্তানের প্রবাহে-প্রবাহেসংক্রমিত হয়েছে –একটি দিন আগেও তো বুঝতে পারি নি দেশ আমার।শহিদের আত্মাহুতি বাঙালির জীবনে সঞ্চারিত করেছে এক অদম্য শক্তি :তাদের একজন আজ নেই;না, তারা পঞ্চাশজন আজ নেই।আর আমরা সেই অমর শহীদদের জন্যে,তাঁদের প্রিয় মুখের ভাষা বাংলার জন্যে একচাপ পাথরের মতোএক হয়ে গেছিহিমালয়ের মতো অভেদ্য বিশাল হয়ে গেছি।সিকান্দার আবু জাফর তাঁর তিমিরান্তিক (১৯৬৫) কাব্যগ্রন্থের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ কবিতায় (রচনাকাল ১৯৫৪) যুগ-যুগান্তের ইতিহাস পরিক্রমায় যেসব অবিনশ্বর স্মৃতিস্তম্ভ দেখেছেন তারই ধারাবাহিকতায় অমর স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে দেখেছেন একুশেরশহিদমিনারকে :আমার কালেইতিহাসের সর্বশেষ পথের বাঁকেএসে দেখলাম :অকস্মাৎ জমাট বেঁধে যাওয়াপুঞ্জীভূত প্রতিবাদে তৈরিআর একটি স্মৃতিস্তম্ভ। চতুর্দিকে তারজমাট রক্তের পুরু আচ্ছাদন।পরিচয়হীন ফলকে লিপিবদ্ধ :‘২১শে ফেব্রুয়ারী।’পাকিস্তানি আজাদিকে যারা ‘জিন্দেগানির দূত’ হিসেবে দেখেছেন সেই পাকিস্তানের যাত্রাপথকে ‘নমরুদের পথ’ হিসেবে চিত্রিত করে পাকিস্তানবাদের বিরোধিতা করে কবিতা লেখার সূচনা করেছিলেন আবদুল গণি হাজারী (১৯২১-৭৬)। নমরুদের সেই পথ থেকে উত্তরণের প্রেরণা হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছেন একুশের প্রেরণাকে। তাঁর সামান্য ধন (১৯৫৯) কাব্যগ্রন্থের ‘ভালোবাসি বলেই’ কবিতার অংশবিশেষ এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয় :অনেক মৃত্যুকে বুকে করে আমাদের বেঁচে থাকাঅনেক ঝড়ের পীড়ন পাঁজরার তলে বরকতের মায়ের কান্না কতবার পৃথিবীর বুক চিরে কতবার নিস্তব্ধ হলো।এত মৃত্যুর কথা স্মরণ করেইআমাদের আয়ু মৃত্যুহীনআর তোমায় ভালোবাসি বলেইজীবন আমারএত সহজে প্রাণ দিয়ে যাই।ঐতিহ্য-অন্বেষী কবি হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’ কবিতায় স্বদেশভূমি মাতৃচেতনার নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত :বস্তিবাসিনী মা অকস্মাৎ স্বাস্থ্যবান সন্তানকে বুকের কাছেধরতে পারলে যেমন করে আহত দিনের অসংখ্য মৃত্যুকে ভুলে থাকতে পারেতেমনি পঞ্চাশটি শহিদ ভাইয়ের অকাল মৃত্যুকে ভুলেছিমা, তোমাকে পেয়েছি বলে।আজ তো জানতে এতটুকু বাকি নেই মাগো,তুমি কি চাও, তুমি কি চাও, তুমি কি চাও(‘অমর একুশে’, বিমুখ প্রান্তর) একুশের রক্তাক্ত দিনটি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা রচনার প্রেরণা হয়ে আছে। একুশের প্রেরণা অভিব্যক্তি পায় তাঁর কবিতায় এভাবে :বাতাসের সোহাগে রাত এলো বুনো,কারা জানি ছাত্রাবাসে মারা গেছে, ‘শোনোশোনো’, তারপর গলি, ঘর, হ্যারিকেন আলোমুহূর্তের মতো চুলে হাত বুলালো,বই মেলে থেমে গিয়ে হৃদয়ের আওয়াজে,আর্তিতে হাড়-ভরা ছায়া কাঁপে লাজেচুন ওঠা দেওয়ালে,মনে মনে বলে, ‘বরকতের চোখে বুঝি ভবিষ্যৎ বুঁজে আছে।এভাবে একুশের প্রেরণা তাঁর কবিতায় ভবিষ্যৎমুখী সম্প্রসারণ পায়। দিলওয়ারের কবিতায়ও একুশের প্রেরণা অনির্বাণ :নদী ও বৃষ্টির জলে যে-দেশে শস্যেরা অফুরানদ্বৈমাতৃক সেই দেশে সাহসী একুশে অফুরান।তাঁর কবিতায় একুশে হয়ে উঠেছে মায়ের প্রতীক :মা আমার বসে আছে রাত্রির নদীর তীরে একাআমি যাবো তার কাছে। কে তুমি কঠিন বাহু মেলেআমাকে ঠেকিয়ে রাখো।(‘রাত্রির নদীর তীরে মা আমার’)একুশের প্রেরণার অন্যতম প্রধান আশ্রয় বাংলা ভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে এই ভাষার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র দেখে ক্ষুব্ধ কবি শামসুর রাহমান পরবর্তীকালে লিখেছেন অসাধারণ কবিতা : ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ :তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো, কী থাকে আমার?উনিশ শো বায়ান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলিবুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।সে-ফুলের একটি পাপড়ি ছিন্ন হলেআমার সত্তার দিকেকত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।ৃ ৃ ৃতোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।কিন্তু তাঁর ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতায় নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয় একুশের প্রেরণা :আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথেকেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো বাএকা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয় – ফুল নয়, ওরাশহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের প্রেরণারই রঙ।সে-চেতনা ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের দৃপ্ত আবেগময়তায় ভাস্বর :আবার সালাম নামে রাজপথে শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগবরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।সালামের বুকে আজ উন্মথিত মেঘনাসালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকাসালামের মুখ আজ তরুণ, শ্যামল পূর্ব বাংলা।এভাবে ভাষা-আন্দোলনের রক্ত আর অশ্রম্ন-ঝরা সংগ্রামী ইতিহাস একাত্তরের সংগ্রামী ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। যেমন, সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা ‘আর কত রক্তের দরকার হবে’র কয়েকটি পঙ্ক্তি :মাতুই এবার নিজেই তবে বলে দেএই একটি শব্দ।উচ্চারিত এই একটি শব্দ লিখতে কতখানি রক্তের দরকার হয়?আমার এ দেহের আর কতটুকু রক্তের দরকার হবে?যখন এ শব্দ আর এই বড় রক্তাক্ত স্বদেশকেউ মুছে ফেলতে পারবে না।মা;বরকত লিখেছে – মাসালাম লিখেছে – মাজববার লিখেছে – মামতিউর-আসাদ ওরা লক্ষ লক্ষ লিখে গেছে – মা।এ-প্রসঙ্গে একুশের কবিতার আরেকটি বিশিষ্ট সংকলনের কথা উল্লেখ করতে হয়। এটি হচ্ছে বাংলা একাডেমি-প্রকাশিত একুশের কবিতা। একাডেমি ১৯৮৩ সালে এটি প্রকাশ করে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত একুশ নিয়ে লেখা ১১৫ জন কবির ১৩২টি কবিতা এতে সংকলিত হয়। সংকলিত কবিতাগুলি বাংলা ও ইংরেজি – এই দুই ভাষায় প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলির মধ্যে রয়েছে : জসীমউদ্দীনের ‘একুশের গান’, সুফিয়া কামালের ‘এমন আশ্চর্য দিন’, আহসান হাবীবের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, ফররুখ আহমদের ‘ভাষা আন্দোলনের নিহত আত্মার প্রতি’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, আবদুল গণি হাজারীর ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, আবুল হোসেনের ‘তোমাকে নিয়ে যত খেলা’, সানাউল হকের ‘অমর একুশে’, আবদুল লতিফের ‘একুশের গান’, শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘স্মৃতিস্তম্ভ’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘কোনো এক মাকে’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘একুশের কবিতা’, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর ‘একুশের গাথা’, ফজল শাহাবুদ্দীনের ‘আত্মা থেকে একটি দিন’, আল মাহমুদের ‘একুশের কবিতা’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘কৃষ্ণচূড়ার মেঘ’, দিলওয়ারের ‘একুশের কবিতা’, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘একুশের কবিতা’, বেলাল চৌধুরীর ‘বর্ণমালার নিরস্ত্র সাহস’, হায়াৎ মামুদের ‘ঘুরে ফিরে ফাল্গুন’, শহীদ কাদরীর ‘একুশের স্বীকারোক্তি’, রফিক আজাদের ‘পঞ্চানন কর্মকার’, আসাদ চৌধুরীর ‘ফাল্গুন এলেই’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, মোহাম্মদ রফিকের ‘মহান একুশে’, মহাদেব সাহার ‘তোমরা কী জান’, নির্মলেন্দু গুণের ‘আমাকে কী মাল্য দেবে দাও’, হুমায়ুন আজাদের ‘বাংলা ভাষা’, আবুল হাসানের ‘মাতৃভাষা’, মাহবুব সাদিকের ‘অবিনাশী বাংলা’, আবুল মোমেনের ‘আমি কি ভুলিতে পারি’, অসীম সাহার ‘মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি’, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘মাতৃভাষা’ ইত্যাদি। একুশ-পরবর্তী অর্ধশত বছরে এদেশের কবিদের সত্তায় প্রবহমান একুশের প্রেরণার প্রতিফলন ঘটেছে এসব কবিতায়। তিনএকুশের গল্প-রচনার সূত্রপাত হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারীকে কেন্দ্র করে। এ-সংকলনে প্রকাশিত একুশের গল্পগুলি হচ্ছে : শওকত ওসমানের ‘মৌন নয়’, সাইয়িদ আতীকুল্লাহর ‘হাসি’, আনিসুজ্জামানের ‘দৃষ্টি’, সিরাজুল ইসলামের ‘পলিমাটি’, আতোয়ার রহমানের ‘অগ্নিবাক’।শওকত ওসমানের ‘মৌন নয়’ গল্পটি ভাষা-আন্দোলন নিয়ে লেখা প্রথম একুশের গল্প। একুশের প্রথম কবিতার মতো এটি লেখা হয় চট্টগ্রামে। গল্পটি যেমন চলচ্চিত্রধর্মী, তেমন নাটকীয়। গল্পে একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার রূপক উপস্থাপন করেছেন লেখক। একটি চলন্ত বাসের সমস্ত যাত্রীর নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে একুশের মর্মান্তিক শোকাবহ ঘটনার মানস প্রতিক্রিয়াকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ-গল্পে। গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন পুত্রশোকে স্তব্ধ এক বৃদ্ধ যাত্রী। কিন্তু এক সময় পুত্রশোককাতর বৃদ্ধ পিতার আর্তনাদে সে-স্তব্ধতা খান-খান হয়ে ভেঙে যায় : ‘কী দোষ করেছিল আমার ছেলে? ওরা কেন তাকে গুলি করে মারল?’ সব যাত্রী এমনকি ড্রাইভারও তার দিকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়। বৃদ্ধের ক্ষোভ নিমেষেই সঞ্চারিত হয় সবার মধ্যে।সাইয়িদ আতীকুল্লাহর ‘হাসি’ গল্পে দেখা যায়, আবুভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় হলে আবুর নীহার খালাও তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি চললে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আবুও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার লাশ বাসায় আনা হলে প্রচ- শোকে নীহার খালা ভেঙে পড়েন।আনিসুজ্জামানের ‘দৃষ্টি’ গল্পে একুশে ফেব্রুয়ারির হৃদয়বিদারক ঘটনা চিত্রিত হয়েছে একটি দরিদ্র পরিবারকে ঘিরে। পেনশনভোগী কেরানি সাদত সাহেবের চশমা ভেঙে গেলেও অভাবের কারণে নতুন চশমা কেনা হয় না। তাঁর চাকরিজীবী পুত্র আসাদ একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হলে পরিবারটিতে বিপর্যয় নেমে আসে। বৃদ্ধ কেরানি অন্ধদৃষ্টিতে মনে-মনে আঁকেন আসাদের জন্ম-আসন্ন সন্তানের ছবি।আতোয়ার রহমানের ‘অগ্নিবাক’ গল্পের নায়ক মনি।দেশবিভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখে বাবা, মা, ভাই-বোনের সঙ্গে মনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে আসে ঢাকায়। এখানে স্থিতু হতে না হতেই শুরু হয় ভাষা-আন্দোলন। মনি সে-আন্দোলনে যোগ দেয় এবং পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়।একুশের গল্পের প্রথম ও একমাত্র উল্লেখযোগ্য সংকলন রশীদ হায়দার-সম্পাদিত একুশের গল্প। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে এটি প্রকাশিত হয়। এতে একুশ নিয়ে লেখা তিন দশকের প্রতিনিধিত্বশীল কিছু গল্প স্থান পায়। হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে অন্তর্ভুক্ত সাইয়িদ আতীকুল্লাহর ‘হাসি’ গল্পটি ছাড়া অন্য গল্পগুলি অন্তর্ভুক্ত হয় এতে। এর বাইরে এই নতুন গল্পগুলি এতে স্থান পায় : সত্যেন সেনের ‘ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রামী’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘কাঁথা সেলাই হইছে নিশ্চিন্ত’, অজিতকুমার গুহের ‘বুলু’, সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘খরস্রোত’, মির্জা আবদুল হাইয়ের ‘আমরা ফুল দিতে যাব’, আবু ইসহাকের ‘প-শ্রম’, শহীদুল্লা কায়সারের ‘এমনি করেই গড়ে উঠবে’, মঈদ-উররহমানের ‘সিঁড়ি’, আনিস চৌধুরীর ‘চেতনার চোখ’, মিন্নাত আলীর‘রুম বদলের ইতিকথা’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘হস্তান্তর’, মুর্তজা বশীরের ‘কয়েকটি রজনীগন্ধা’, মাফরুহা চৌধুরীর ‘সেদিনের এক লগ্ন’, শহীদ আকন্দের ‘যখন পারি না’, জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘সম্রাট’, রাবেয়া খাতুনের ‘প্রথম বধ্যভূমি’, রশীদ আল হেলালের ‘বরকত যখন জানত না সে শহিদ হবে’, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘আমি খুনি হতে চাই না’, শওকত আলীর ‘অবেলায় পুনর্বার’, রাজিয়া খানের ‘শহীদ মিনার’, আবুল হাসানাতের ‘আরও কিছু রক্ত’, নূর-উল আলমের ‘একালের রূপকথা’, মকবুলা মনজুরের ‘শপথের সূর্য’, খালেদা এদিব চৌধুরীর ‘বাইশ বছর পরে’, রিজিয়া রহমানের ‘জ্যোৎস্নার পোস্টার’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘স্মৃতিময়’, মাহমুদুল হকের ‘ছেঁড়া তার’, আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘দাগ’, রশীদ হায়দারের ‘সুদূরের শহীদ’, জুলফিকার মতিনের ‘জাতিস্মরেরা’, হরিপদ দত্তের ‘তার ফিরে আসা’, সেলিনা হোসেনের ‘ফিরে দেখা’, হারুন হাবিবের ‘শিকড়’, পূরবী বসুর ‘মায়ের দ্বিতীয় বিবাহ’, তাপস মজুমদারের ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সম্পর্কিত একটি গল্পকরী খসড়া-সম্পর্ক : ১৯৫২-২০৫২’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘সংকোচ’ এবং আহমদ বশীরের ‘উনিশ শ তিয়াত্তরের একটি সকাল’, মইনুল আহসান সাবেরের ‘মরে যাওয়ার সময় হয়েছে’। এসব গল্পের কয়েকটি সম্পর্কে সংক্ষিপে আলোকপাত করছি।সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘খরস্রোত’ গল্পে ১৯৫০-এর দশকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষা-আন্দোলনের যে-প্রভাব পড়েছিল সে-দিকটি ফুটে উঠেছে। অবসরপ্রাপ্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছেলে মুনিরের জন্যে চাকরি ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু সে ব্যস্ত একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের প্রস্ত্ততি নিয়ে। এজন্যে তার ওপর অসন্তুষ্ট তিনি। তিনি ছেলেকে বাইরে যেতে নিষেধ করেন। কিন্তু মুনির জানায়, দেশের জন্যে তার কিছু করার আছে। সেদিন সে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। এভাবে বাংলা ভাষার আন্দোলনের কথা বারবার উঠে এসেছে কবিতায়-গল্পে-উপন্যাসে। সেই সাথে ১৯৫০ সালে প্রকাশিত নতুন কবিতা সংকলনে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, চাঁদ ফুল পাখি মেঘ নক্ষত্র শিশির আর নারীর প্রণয় আজো মিথ্যা নয়।’ মিথ্যে নয় বলেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে বাংলা ভাষা বিকৃতিরোধ করার মহান লক্ষ্যে। এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে চির অমর করে রাখতে সকল শ্লোগানে ‘বাংলাদেশ’ নামটির প্রতি সর্বোচ্চ চেষ্টার মধ্য দিয়ে উচ্চারণ করতে। পাশাপাশি যতদূর সম্ভব বাংলাদেশে উর্দু শ্লোগান না দেয়ার চেষ্টাটি আমাদেরকেই করতে হবে। উপরে অনেক কথা বলেছি, আর তাই সেই কথাগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বলতে চাই- শুধু একুশ এলেই নয়; সারা বছর ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ অথবা ‘জয় বাংলা’ না বলে চলুন বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান রেখে ‘বিজয়’ আর ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন ভূখন্ডের প্রতি সম্মান রেখে ‘বাংলাদেশ’ উচ্চারণ করি। যার ঐক্যবদ্ধতায় আমাদের বায়ান্ন ও একাত্তর গর্বিত থাকবে ‘বিজয় বাংলাদেশ’ শ্লোগানের মধ্য দিয়ে…
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি
Leave a Reply