ভোলা প্রতিবেদক ॥ তখন রাত সাড়ে দশটা, ভোলার ইলিশা লঞ্চ টার্মিনাল। ঢাকা থেকে এমভি কর্ণফুলী-১ লঞ্চে ভোলায় এসেছেন জুবায়ের হোসেন (ছদ্মনাম)। ঢাকা থেকে ২১ ইঞ্চি একটি টিভি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তিনি। টার্মিনালে নামার আগেই লঞ্চের ডেকে হলুদ গেঞ্জি পরা শাহে আলম ও নীল জামা পরা খোরশেদ নামে দু’জন লোক জুবায়েরকে ঘিরে ধরেন। তাঁরা তখন নিজেদেরকে ঘাটের সরদার নামে পরিচয় দেয়। জুবায়েরের সঙ্গে থাকা টিভির জন্য ‘ঘাটের টাকা’ দিতে হবে বলে ১৫’শ টাকা দাবি করেন তারা। মালামাল নিজে বহন করলেও টাকা দিতে হবে তাদের। জুবায়ের ৫০০ টাকা দিতে চাওয়ায় টিভি নিয়ে টানা-হেঁচড়া ও হুমকি-ধমকিও দেয় এ দু’জন সরদার। গত ৯ অক্টোবর এ ঘটনা ঘটে। ঘাটে তখন এই প্রতিবেদক উপস্থিত ছিলেন। প্রথমে গোপনে ভিডিও করলেও যাত্রী বেশে পাহারায় থাকা তিনজন কুলি বিষয়টা টের পেয়ে যান। পরে প্রকাশ্যে ভিডিও করার সময় দফায় দফায় বাঁধা দেন তারা। সংঘবদ্ধ এই চক্র এভাবে টিভি, ব্যাগ, বস্তা, লাগেজ সঙ্গে থাকা লঞ্চ যাত্রীদের টার্গেট করে এবং চাঁদাবাজি করে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। ইলিশা নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘ঘাটের টাকা’র নাম করে চাঁদা তোলা তো দূরের কথা যাত্রীদের অনুমতি ছাড়া তাদের মালামালে হাত দেওয়ারও সুযোগ নেই। অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু চাঁদাবাজি আর যাত্রী হয়রানিই নয় ইলিশা টার্মিনালে চলছে নানা অনিয়ম। যার পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইলিশা ঘাট সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, কুলিদের মাধ্যমে অবৈধভাবে সংগ্রহ করা টাকার অংকটা অনেক বড় হওয়ায় এর পেছনে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অপর আরেক সূত্র জানায়, যাত্রীদের নিরাপত্তা ও ইলিশা নদীবন্দর সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা, নিরাপত্তা কর্মীরা অর্থনৈতিক সুবিধা, কখনো কখনো সিন্ডিকেটের চাপের কারণেও কুলিদের চাঁদাবাজি ও অনিয়মের সুযোগ করে দেন। হয়রানির শিকার জুবায়ের হোসেন বলেন, তাঁর বাড়ি ভোলার ইলিশা কালুপুর। বেশ কয়েকবছর ঢাকায় ছিলেন তিনি। এখন গ্রামের বাড়িতে চলে আসছেন। তাই ঢাকার বাসায় থাকা টিভিটি তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। কুলিরা ১৫শ’ টাকা দাবি করে। ৫০০ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হয়েছি। তারপরও তারা বলছে, তাদের কথামতো টাকা না দিলে টিভি নিয়ে যেতে পারবো না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাদেরকে নাকি ৩ হাজার টাকা দিতে হবে। এর আগেও ইলিশা ঘাটে একাধিকবার এই গ্রুপের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন বলেও জানান জুবায়ের। লঞ্চে ঢাকা-ভোলা রুটের নিয়মিত যাত্রী আনিস বলেন, ইলিশাঘাট টার্মিনালে চাঁদাবাজি ও যাত্রী হয়রানির এ দৃশ্য নিয়মিত। এক প্রশ্নের জবাবে আনিসের বন্ধু সুমন বলেন, অভিযোগ দিয়ে কি হবে? ঝামেলার ভয়ে অনেকে নীরবে টাকা দিয়ে চলে যান। তিনি বলেন, কুলিরা বলে বন্দর কর্মকর্তারা তাদেরই লোক। ঘাট কর্তৃপক্ষ নাকি তাদের টাকা তোলার দায়িত্ব দিয়েছে। সেখানে আমরা কার কাছে অভিযোগ করবো? সুমন আরও বলেন, যখন চাঁদাবাজি হয় তখন আশেপাশে সংশ্লিষ্ট কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি অন্য যাত্রীরা এগিয়ে আসে না, না দেখার ভান করে চলে যায়। অপর এক যাত্রী নজরুল ইসলাম বলেন, চাঁদার জন্য কুলিরা আমাদের সঙ্গে মাস্তানের মতো আচরণ করে। এরা পোষা মাস্তান! এটা দুঃখজনক। ১১ অক্টোবর ঢাকা থেকে সেই কর্ণফুলী-১ লঞ্চে রাজাপুর ইউনিয়নের জনতা বাজারের আলামিন নামে এক ব্যবসায়ি তাঁর দোকানের জন্য ঢাকা থেকে একটি ব্যাগে করে স্বল্প কিছু মালামাল নিয়ে রাত সাড়ে দশটার দিকে লঞ্চ থেকে ইলিশা ঘাটে নামলে ব্যাগ বাবদ ৩০০’শো টাকা দাবি করেন শাহে আলমসহ তাঁর দলের কয়েকজন। একপর্যায়ে আলামিনের সাথে প্রায় ঘন্টাব্যাপী বাগবিত-ায় জড়িয়ে পড়েন এই মাস্তান দল। পরে পরিচিত একজনের মাধ্যমে ছাড়া পান আলামিন। আলামিন জানান, ঢাকা সদরঘাটে ব্যাগের জন্য ৫০ টাকা দিয়েছি। ইলিশা ঘাটে ব্যাগের জন্য ৩০০’শো টাকা দাবি করে। আমি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁরা আমার ব্যাগ আটকিয়ে রাখে। আমরা এই মাস্তানদের হাতে জিম্মি। এঁরা রাতের অন্ধকারে যাত্রীদের প্রতি নিয়ত হয়রানি করেই যাচ্ছে। যাত্রী হয়রানি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে টার্মিনালের দায়িত্বরত বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক কামরুল বলেন, ‘বিষয়টা নিয়ে প্রচ- রকম বিব্রতকর অবস্থায় আছি, এ বিষয়ে টেককেয়ারও করছি। ’ হয়তো সামনে এরকম আর হবেনা। জানতে চাইলে ইলিশা ঘাটের ইজারাদার ও ইলিশা ইউনিয়ন আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মাষ্টার মোহাম্মদ সরোয়ার বলেন, আমার কড়া নির্দেশ রয়েছে যাত্রী হয়রানির বিষয়ে। তবুও কেউ এরকম যাত্রী হয়রানি করলে বা অতিরিক্ত টাকা দাবি করলে আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখব।
Leave a Reply