দখিনের খবর ডেস্ক ॥ ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘূর্ণিঝড় ভোলা সাইক্লোনের ৫০ বছর। ভয়াল রাতের ধ্বংসযজ্ঞের কথা আজও ভুলতে পারেনি দ্বীপজেলা ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মানুষ। স্বজন হারানোর দুঃখ স্মৃতি আজও কুরে কুড়ে খাচ্ছে তাদের। দূর্যোগের সেই দিনে উপকুলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা সাগর মোহনার ইউনিয়ন চর কুকরি মুকরি। জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ওই চরের সকল মানুষ। পরদিন কোন প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায়নি। বিছিন্ন মনপুরা উপজেলার ৪০ হাজার মানুষের ২৬ হাজারই প্রাণ হারান ওই ঝড়ে। তথ্য দেওয়ার কোন লোক ছিল না। ভয়াবহ ক্ষয় ক্ষতির সেই খবর দেশবাসির কাছে পৌঁছেছে একসপ্তাহ পরে। এর পর থেকেই নভেম্বর আসে উপকুৃলীয় মানুষের আতঙ্ক হয়ে। ১১ নভেম্বর সকালে ভোলায় ভুমিকম্প হওয়ায় এ আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। এই দিনে নিহত স্বজনদের স্মরণে আজ জেলার বিভিন্ন এলাকায় কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।
১৯৭০ সালের এই দিনে ছিল মাহে-রমজানের মাস। আকাশ অন্ধকার হয়ে দিনভর পড়ছিল গুড়ি- গুড়ি বৃষ্টি। টানা বাতাস ছিল দুই দিন আগ থেকেই। উপকুলের উপর দিয়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঝড়ে রেখে গিয়েছিল শুধু ধ্বংসযজ্ঞ। রাতে উপকুলের উপর দিয়ে বয়ে যায় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াভয় ঘূর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছাস। ওই জলোচ্ছসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় দ্বীপজেলা ভোলাসহ উপকুলীয় জনপদ। প্রাণহাণি ঘটে ভোলার লক্ষাধিকসহ উপকুলের প্রায় ৫ লাখ মানুষের।
চরফ্যাশন উপজেলার নজরুল নগর ইউনিয়নের আব্দুর রশিদ ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে স্বজন হারা একজন। তিনি জানান, ৭০ এর ১২ নভেম্বর তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। ওই বয়সের অনেক স্মৃতিই এখনো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তার পরিবারের ৫ সদস্যের মধ্যে ৩ সদস্য বেঁচে যান। ওই রাতের ভয়াল থাবায় মারা যায়, তার মা ও বোন সহ ২ জন। তিনি আরো বলেন, বেড়াতে আসা ২ খালাতো ভাই-বোনও ভেসে যায় স্রোতের তোড়ে। হাওলাদার বাড়ির ২টি ঘরের অন্যটিতে বাস করতো তার মামার পরিবার। সেই রাতে তার মামি, মামাতো বোনকেও হারাতে হয়েছে। ওই বাড়ির ৯ জন প্রাণ হারিয়ে ছিল ১২ নভেম্বরের ঝড়ে।
ওই সময়ের অনেকেই জানান, ‘শেষ রাতে পানি নামতে শুরু করে। সেই সাথে পড়েছিল প্রচন্ড শীত। এ জন্য প্রসূতী মা আর শিশুর মৃত্যু হয়েছে সবচেয়ে বেশি। নোনা জল আর পানির সাথে আসা বালিতে অন্ধ হয়েছে অনেকে। ভোরের আলো ফুটে ওঠতে ১২ নভেম্বর ১৯৭০ চোখে পড়ে গাছে গাছে বাদুরে মতো মানুষ ঝুলে থাকতে। কেউ মৃত। কেউ অজ্ঞান। স্রোতের টানে শরীরের বস্ত্র ভেসে গেছে। কি পুরুষ, কি নারী; লাশ আর লাশ। এক টুকরা কাপড় পেলে জড়িয়ে ওমনি আব্রু ঢেকেছে জীবিতরা। মৃতদের বিনা জানাযায় দেওয়া হয়েছে কবর। চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের হান্নান মাস্টারের পরিবারের ১৭ জন সদস্যের কেউ বেঁচে ছিল না। এ রকম ঘটনা ঘটেছে অনেক। আবার কেউ অলৌকিক ভাবে বেঁচেছিল।
মুজিব নগর ইউনিয়নের সিদ্দিক মিয়া মাঝি বাড়ির সালেমা বিবি (৬৯) বলেন, “ নামাজ পইর্যা হুইছি। রাইত্যা পানির স্রোতে গর(ঘর) হুদ্দা ভাইস্যা গেছি। বুহে ১১ মাসের পুত (ছেলে)। আরেক পুত ৩/৪ বছরের। দুই পুতেরই ভাসাইয়্যা দিলাম!”এই বলেই সালেমা কেঁদে ফেলে। কান্না থামিয়ে আবার বলেন, “ নিজেও ভাইস্যা গেছি। কই গেছি কইতাম পারি না। সকালে চোক ( চোখ) মেইল্যা দেহি রেন্ডি ( রেইনট্রি) গাছের মাতায় আটকাইয়্যা আছি। আমার লগে সাপও জুইল্যা আছে। দুইডা পইখ (পাখি) মাতার চুলে বাইয়্যা আছে। সাপ নামতে আছে। তয় সাপে কিছু কয় না। শরীর বাইয়্যা নামে। দেহি, স্রোতের লগে আমার বড় পুতের নাইন কি জানি ভাইস্যা যায়। ”
ওই জ্বলোচ্ছাসে ভোলার লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে। শুধু মনপুরা উপজেলয় মারা গেছে প্রায় ২৬ হাজার মানুষ। চরফ্যাশন-লালমোহন- তজুমদ্দিন -দৌলতখানের ক্ষতি হয়েছে সবেচেয় বেশি। কিন্তু এমন বিভৎস ট্রাজেডির কথা দেশবাসীকে, বিশ্ববাসীকে তৎকালিণ পাকিস্তান সরকার জানায়নি। তৎকালিণ “পূর্বদেশ” পত্রিকার সাংবাদিক ও বর্তমানে ভোলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলার কন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক এম. হাবিবুর রহমান স্মৃতি চারণ করে বলেন, তিন দিন পর তার পাঠানো সংবাদ ও ছবি তৎকালিন পূর্বদেশ পত্রিকায় “ভোলার মানুষ কাঁদো, গাছে গাছে ঝুলছে মানুষের লাশ” এই শিরোনামে প্রকাশ হওয়ার পরই বিশ্ববাসী ভোলা জেলাসহ চরফ্যাশন উপজেলার উপকূলের মানুষের সর্বস্ব হারানের করুন কাহিনী জানতে পেরেছেন।
(ওয়ারপো)’র তথ্য মতে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এ যাবত কালে যত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে সবচেয়ে বেশী মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে উপকুলীয় এলাকার প্রায় ৫ লাখ মানুষেরর প্রাণহানী হয়েছে। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ৪ লাখ ৭০ হাজার। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় ৯ বার উপকুল এলাকায় আঘাত হেনেছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ৭০-এর পরে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় উপকুলীয় এলাকায় বিভিন্ন আঘাত হানলেও এতো বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
এ বছর ১৬ জেলায় ৪২টি উপজেলায় ৫৪ স্থানে উপকূল দিবস পালন করা হবে। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবারও বেড়ে গেছে ঝড়-জলোচ্ছাস। আতঙ্ক বেড়ে গেছে ভোলার ২০ লাখ মানুষের মধ্যে। ঝড়- জলোচ্ছাস নিত্যসঙ্গী ভোলার মানুষ যেন নিরাপদে থাকতে পারে এই দাবী সরকারের কাছে। প্রতিবছর ভোলা সাইক্লোনে নিহতদের স্মরণে দোয়া মিলাদ ও কোরআন খতম কবর জিয়ারত করা হয়। প্রতিবছর বেসরকারিভাবে উপকূল দিবস পালিত হলেও সরকারিভাবে এখনো উপকূল দিবসের স্কীকৃতি মেলেনি। পর্যাপ্ত পরিমাণ আশ্রয় কেন্দ্র ও সরকারি ভাবে উপকূল দিবসের স্কীকৃতির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন চরফ্যাশন উপজেলার উপকূলবাসী।
Leave a Reply