আবদুর রহমান খান:
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় করোনা মহামারির মধ্যে গত ৫ আগস্ট আনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে শ্রীলঙ্কা পডুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) দল।
এরই মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বলতে শুরু করেছে, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা স্বৈরশাসনের পথেই পা বাড়িয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী দেশটি গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত। সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার সমন্বয়ে। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ছয় বছরের জন্য। এসময় তিনিই একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান এবং সামরিক বাহিনীর প্রধান। রাষ্ট্রপতি দেশের সংসদ এবং ২২৫ সদস্যের আইন প্রণয়নকারী পরিষদের কাজে দায়বদ্ধ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত সংসদ সদস্যের মধ্য থেকে একজনকে মন্ত্রিসভার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির ডেপুটি হিসেবে কাজ করেন এবং সংসদের সরকারি দলের নেতৃত্ব দেন। রাষ্ট্রপতি সংসদের এক বছর কার্যক্রম অতিবাহিত হবার পর সংসদ স্থগিত অথবা সমাপ্তি ঘোষণা করতে পারেন। রাষ্ট্রপতির হাতে এত বিপুল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকার কারণে দেশটিকে একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রও বলা হয়।
গত নভেম্বরে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জিতে যান গোতাবায়া রাজাপাকসা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই গোতাবায়া তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসাকে। প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও নতুন সরকারে থাকছেন রাজাপকসা পরিবারের আরো তিন সদস্য।
দেশের সংবিধান আনুযায়ী প্রেসিডেন্ট কোনো মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে থাকবেন না। কিন্তু ওই বিধানকে আবজ্ঞা করে প্রেসিডেন্ট গোতাবায় নিজেই নিজের হাতে নিয়ে নেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। একইসাথে তিনি দেশের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন্-চিফ। তার ভাই রাজাপাকসার হাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়াও ন্যস্ত করা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা গোতাবায়া রাজাপাক্ষে তার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক ও এখনো চাকরিরত সামরিক কর্মকর্তাদের। এসব সামরিক কর্মকর্তারা শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ দমনে এবং সশস্ত্র এলটিটি গেরিলাদের নিশ্চিহ্ন করার কাজে রাজাপাকসার পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
ইতোমধ্যে মেজর জেনারেল (অব. )কমল গুনারত্নকে প্রতিরক্ষা চিব হিসেবে বহাল রেখে বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে থাকা পুলিশসহ ও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায়িত্বও তাকে দেয়া হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত এডমিরাল জয়নাথ কোলামবাজিকে নিয়োগ করা হয়েছে পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে।
এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে গোতাবায়া দেশ একটি প্রেসিডেন্সিয়াল ডিকটেটরশিপ পরিচালনা জন্য সামরিক বাহিনীকে তার ক্ষমতার প্রধান ভিত্তি হিসেবে বেছে নিয়েছে।
এখানেই থেমে থাকেননি রাজাপাকসা। নির্বাচনের সময় তার দল এসএলপিপি যেমনটি দাবি করেছে, সেভাবে দ্রুতই সংবিধান সংশোধন করে ফেলেছেন। সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কিছুটা রাশ টেনে ধরার বিধান ছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে তা বাতিল করে দিয়ে নতুন ২০তম সংশোধনী আনুমোদন দিয়েছে রাজাপাকসার নতুন মন্ত্রী পরিষদ।
গত ২০ আগষ্ট নতুন সংসদে তার নীতিনির্ধারণী ভাষণে রাজাপাকসা ঘোষণা করেছেন, সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী বাতিল করে এবার “এক দেশ এক আইন” নীতির ভিত্তিতে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হবে।
তবে, রাজাপাকসার এই “এক দেশ এক আইন” নীতিকে সাম্প্রদায়িক বলে অভিহিত করেছে বিরোধী পক্ষ। তারা বলেছেন, এসব পদক্ষেপের ফলে সিংহলি জাত্যাভিমান প্রধান্য পাবে এবং সংখ্যালঘু মুসলিম ও তামিলদের জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেয়া বিশেষ কিছু সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে। এটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল উদ্যোগ।
এদিকে, বিশ্ব মহামারির বিরুদ্ধে জয়ী হবার ফাঁকা আওয়াজ দিলেও, কেভিডে কারণে অর্থনৈতিক সঙ্কট বাড়ছে, শ্রমিক শ্রেণীর আয়-রোজগার কমেছে, তারা বেকার হয়েছে এবং এসবের ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে।
সরকারের সমর্থন পেয়ে বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ও কর্মচারী ছাঁটাই করে দিয়েছে, যাদের রেখেছে তাদেরও বেতন কমিয়ে দিয়েছে। এ সময় কেবলমাত্র উৎপাদনশীল খাতেই চার লক্ষ লোকের চাকরি চলে গেছে। অথচ, আগের সরকারের আমলে ২০১৮ সালে এই শ্রমিক ও কৃষকদের দ্বারা সৃষ্ট আন্দোলনের ওপর নির্ভর করেই রাজাকসারা প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টারি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, বিপুল বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে এসএলপিপি দল শ্রমিক-কৃষকদের দেয়া নির্বাচনী ওয়াদাগুলো দ্রুতই ভুলে যাবে এবং তাদেরকে ফের আন্দোলনের পথে ঠেলে দেব।
সেরকম লক্ষণ এর মধ্যেই দেখা দিয়েছে। কলেম্বো পোর্ট বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে ৫ আগষ্ট নির্বাচনের দু’দিন আগে পোর্টের দশ হাজার শ্রমিক টানা দু’দিন কর্মবিরতি পালন করেছে। নির্বাচনের দু’দিন পরে আবার সেই পোর্ট শ্রমিকেরা তাদের বেতন হ্রাসের প্রতিবাদে তিন দিন ধরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণ দেখিয়ে পোর্ট শ্রমিকদের বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
এসতাবস্থায় শ্রীলঙ্কার সমাজতান্ত্রিক দল সোসালিস্ট ইকুইটি পার্টি শিল্প শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক ও যুব সমাজকে সতর্ক করে দিয়েছে যে, রাজাপাকসার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্টের সরকার সামরিক শক্তির সমর্থনে শিগগিরই জনগণের বিরদ্ধে সর্বাত্মক উৎপীড়ন শুরু করবে। যেকোনো রকম প্রতিবাদ দমনে পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হবে নির্দয়ভাবে। তাই শ্রমিক-কৃষক-জনতাকে এখনি প্রস্তুতি নিতে হবে রাজাপাক্ষের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে।
সোসালিষ্ট ইকুইটি পার্টি শ্রমিকদের কর্মস্থলে, কৃষি খামারে এবং প্রতিটি জনপদে স্বাধীন এ্যকশন কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার জনগণের অধিকার রক্ষার আগামী আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য দেশের শ্রমিক-কৃষক ও যুব সমাজের প্রতি আহবান জানিয়েছে এ বামপন্থী দলটি।
ক্যান্ডিতে শপথ অনুষ্ঠানের পর মন্দির ত্যাগ করেন দুই ভাই- প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা (ডানে) ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসা
Leave a Reply